বাবা-মা, ভাই-বোন, শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব—পৃথিবীর সবাই আমার ভালো চায়। সবার এত ভালো চাওয়ার চাপে পড়ে আমি যে কী চাই জীবনে, তা কোনোদিন বুঝে উঠার সময় পাইনি। অন্যের চাওয়া অনুসারে নিজের ভালোমন্দ, চাওয়া-পাওয়া নির্ধারণ করতে করতেই জীবনের চল্লিশটা বছর পার করে দিলাম। এতদিন পর হঠাৎ মনে হচ্ছে, জীবনটাকে যদি আবার নতুন করে শুরু করতে পারতাম!
ছোটবেলা থেকেই আমি খুবই লক্ষ্মী টাইপের মেয়ে। পাশের বাসার আন্টিরা নিজের ছেলেমেয়েদেরকে যাদের পা ধোয়া পানি খেতে বলে, সেইরকম বাড়াবাড়ি রকমের লক্ষ্মী। আমি পড়াশোনায় ভালো, রান্না এবং ঘরকন্নার কাজে পারদর্শী, লাজুক, বিনয়ী, ধার্মিক—এধরণের যা যা গুণ থাকা প্রয়োজন সব আমার আছে। গুরুজনদের সবসময় মান্য করি, একেবারে সাত চড়েও রা কাড়ে না টাইপ। ভালোত্ব ওভারলোডেড বলা যায়।
তবে এই ভালো হওয়া কিন্তু মোটেও সহজ ব্যাপার না। তাহলেতো সবাই আমার মতো ভালো হয়ে যেত। এর জন্য সারাদিন আমাকে যারপরনাই কষ্ট করতে হতো। সকালের আরামের ঘুম ছেড়ে উঠে নামাজ পড়া, সারাদিন পড়াশোনা করা, সবসময় সবার কথামতো চলা—এসব ছোট্ট একটা মেয়ের জন্য সহজ ছিল না। একটু যখন বড় হলাম, তখন তো আরো কষ্ট।
আমাদের সামনের ফ্ল্যাটের ছেলেটার প্রতি এক ধরনের তীব্র আকর্ষণ বোধ করতাম। সে প্রায়ই বারান্দায়, বাসার সামনে খেলাধুলা করতো। মন ছুটে যেত, তবুও কোনোদিন তার সামনে যাইনি। পাছে কেউ আমাকে খারাপ ভাবে? সবার কাছে ভালো হবার আকাঙ্খায় ক্লাসে সবসময় প্রথম সারিতে বসতাম, পড়তে ইচ্ছা না করলেও জোর করে পড়তাম। সিনেমার নায়িকাদের মতো অনেক সাজগোজ করার শখ থাকলেও আমার পোশাক-আশাক আর সাজসজ্জা সবসময় ছিল মার্জিত এবং সাদামাটা।
কাজিনরা একসাথে হলে যখন সবাই হাহাহিহি করে উচ্চস্বরে হাসাহাসি ঠাট্টাতামাশা করতো, আর বাড়িতে মা-চাচীরা বেহায়ার মতো হাসার জন্য তাদের বকা দিতেন, তখন সবার সাথে থেকেও আমার আবেগের প্রকাশ ছিল খুবই নিয়ন্ত্রিত।
তবে আমার এই কষ্টের প্রাপ্তিটাও অবশ্য কম ছিল না। চারিদিকে ছিল আমার জয়জয়কার। মা-বাবার গর্ব ছিলাম আমি। মামা-চাচারা আদর করে বলতো, আমি নাকি তাদের মেয়ে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা গর্ব করে বলতেন, “দ্যাখো, আমার ছাত্রী।” সবার কাছ থেকে ভালোত্বের প্রত্যয়নপত্র পাওয়া মনে হয় নেশার মতো। আর আমি সেই নেশার ঘোরে ভালো ভালো থেকে আরও ভালো হওয়ার পেছনে ছুটে বেড়াতাম সারাদিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় কোনটা আমার জন্য ভালো তা নিয়ে ছিল নানা মুনির নানা মত। কেউ বললেন আর্কিটেক্ট হতে, কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, আবার কারো ইচ্ছা ছিল আমি যেন লইয়ার হই। সবার আলোচনায় অবশেষে ঠিক হলো আমার জন্য সবচেয়ে ভালো হবে আর্কিটেকচার। আমি নাকি পড়াশোনার পাশাপাশি একজন সৃজনশীল আঁকিয়েও। আমিও বুঝলাম যে এটাই আমার জন্য সবচেয়ে ভালো।
দেশের সবচেয়ে নামকরা এক প্রতিষ্ঠানে স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা শুরু করলাম। পরিবার আর শুভাকাঙ্খীদের দৃঢ় মতামত ছিল, “পড়াশোনা শেষ করার আগে প্রেম-বিয়ে এসবের চিন্তা মাথায় আনাই খারাপ।” এসব চিন্তা আমার সবসময় মাথায় আসলেও তা বাস্তবায়নের দুঃসাহস করে আমার ভালোত্ব নষ্ট করার ইচ্ছা কখনও হয়নি।
অনার্সের প্রথম বর্ষে দুই-একজন ছেলে আমার প্রতি সামান্য আগ্রহ দেখালেও আমার নিরস-বিরস ব্যক্তিত্বে স্বাভাবিকভাবেই অতি সত্বর আমার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলত তারা।
পড়াশোনা শেষ করার ঠিক আগে আগে আমার সব শুভাকাঙ্খীরা আমার জন্য পাত্র দেখতে উঠে পড়ে লাগলেন। আমি দেখতে সাদামাটা হলেও আমার ভালোত্বের জয়গান সবার মুখে মুখে। তাই ভালো প্রস্তাবের তেমন কোনো অভাব হয়নি। ভালো ভালো পাত্রদের থেকে বাছাই করে সবচেয়ে ভালো পাত্রটাকেই আমার জন্য নির্বাচন করা হলো।
পাত্রের সাথে আমার দেখা-সাক্ষাৎ, মেলা-মেশার সুযোগ করে দেওয়া হলো। হাজার হলেও এটা হলো আধুনিক যুগ। ছেলে-মেয়ে নিজেরা নিজেদের ভালোভাবে বুঝে-শুনে জেনে সিদ্ধান্ত নিক, এমন একটা ভাব। এমন ভাব হলে কী হবে, আমার কাছে এখানে আমার নিজের সিদ্ধান্তের কোনো সুযোগ আছে বলে একটুও মনে হয়নি।
আমার জন্য সবচেয়ে ভালোটা ইতিমধ্যে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে এবং একজন ভালো মেয়ে হিসেবে সেটা মেনে নেওয়াই আমার কর্তব্য মনে হয়েছে।
পাত্র অবশ্য আসলেই ভালো। দেখতে মোটামুটি ভালো, পড়াশোনায় খুবই ভালো, শিক্ষিত এবং স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে, কথাবার্তায় ভদ্র এবং মার্জিত। আমার একেবারে প্রকৃত জুটি। সোনায় সোহাগা যাকে বলে। ছেলে বর্তমানে ইংল্যান্ডে ভালো চাকরি করে।
বিদেশে গিয়ে আমার আরও ভালো হবে, সেখানে গিয়ে আমি উচ্চশিক্ষা নিয়ে আরও শিক্ষিত হতে পারবো। পাত্রের কোনো খুঁত আমি ধরতে পারলাম না। কিন্তু কেন জানি তার প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণও বোধ করিনি—না মনের দিক থেকে, না শরীরের দিক থেকে।
তবে আমার ভালোর খাতায় আরো ভালো যোগ করে ভালো পাত্রের সাথে ঘটা করে বিয়ে হয়ে গেলো আমার।
বিয়ের পর ইংল্যান্ডে নতুন জীবন শুরু হলো আমার। আমার স্বামী মানুষটি আসলেই ভালো। সে আমাকে মনে হয় সত্যিই ভালোবাসে। আমাদের ছোট্ট সাজানো সংসার। কোনো ঝুটঝামেলা নেই, কষ্ট নেই, অস্বচ্ছলতা নেই।
আমার স্বাধীনতায় কোনো হস্তক্ষেপ নেই, আমি চাইলেই আমার ইচ্ছামতো জীবনটাকে সাজাতে পারি। কিন্তু সমাজের বেঁধে দেওয়া ভালোত্বের সংজ্ঞা অনুসারে চলতে চলতে আমার ইচ্ছাটা যে কী—আমি তো কোনোদিন বুঝে দেখার চেষ্টা করিনি। আমি শুধু জানি ভালো হয়ে চলতে। অতঃপর ভালো জায়গায় আবার পড়াশোনা শুরু করলাম। নিপুণ হাতে সংসারের কাজ করা শুরু করলাম। কখনো স্বেচ্ছায়, কখনোবা অনিচ্ছায় দক্ষ অভিনেত্রীর মতো প্রতি রাতে স্বামীর চাহিদা মেটানো শুরু করলাম। কোথাও যেন কোনো খুঁত থাকে না, এটাই যেন আমার জীবনের মূলমন্ত্র। জীবনের একমাত্র চালিকা শক্তি।
পড়াশোনা শেষ করে ফটাফট ভালো একটা চাকরিও পেয়ে গেলাম। এদেশে আর্কিটেক্টদের চাকরি পাওয়া বেশ ঝক্কির ব্যাপার। অনেক সময় শুরুর দিকে বিনাবেতনে চাকরি করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয়। আমার ক্ষেত্রে সেরকম কিছুই হলো না। একবারেই ভালো একটা চাকরি পেয়ে গেলাম এবং সেখানে খুব তাড়াতাড়িই ভালো করতে থাকলাম। এতদিন শুভাকাঙ্খীদের অনুরোধ ছিল যে সেটেল না হয়ে যেন বাচ্চা-কাচ্চার কথা চিন্তা না করি। আমিও ভালো মেয়ের মতো সেই মোতাবেক চলেছি। এরপর চাকরি পাওয়ার সাথে সাথেই আবার সবার আদেশ—বয়স হয়ে যাচ্ছে, এখনই যেন আর দেরি না করে বাচ্চা নিয়ে নেই। এখনই বাচ্চা নেওয়ার সবচেয়ে ভালো সময়।
“ভালো” শব্দটা আমার জীবনে একেবারে ম্যাজিকের মতো। কোনো কিছু ভালো শুনলেই তা আমার অর্জন করা চাইই চাই। কিন্তু জীবনে এই প্রথম বিশাল একটা ধাক্কা খেলাম। দিনের পর দিন চেষ্টা করার পরও কিছুতেই কনসিভ করছিলাম না। বছর ঘুরতে ডাক্তার দেখালাম। আমাদের দুইজনেরই নানা টেস্ট করার পর কোনো সমস্যা পাওয়া গেল না। ডাক্তার বুঝালেন, অনেক সময় এসব ব্যাপারে টাইম লাগে। একটু সময় দিতে এবং কনসিভ করার সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য কিছু উপদেশ দিয়ে ছেড়ে দিলেন।
আবার চেষ্টার পালা, কিন্তু কোনো আশার আলো দেখতে পেলাম না। এদিকে আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। এটাতো ভালো ব্যাপার না। বাবা-মা এত হতাশ যে তাদের সাথে কথা বললে মনে হয় তারা এই দুঃখে যেকোনো সময় মারা যেতে পারেন। শ্বশুর-শাশুড়ি, পরিবার-পরিজন, শুভাকাঙ্খীরা সবাই চিন্তিত। সবাই দিনরাত উপদেশ দিতে লাগলেন। এটা চেষ্টা করো, সেটা চেষ্টা করো, অন্য ডাক্তার দেখাও, ইংল্যান্ডের ডাক্তার ভালো না, সিঙ্গাপুরের ডাক্তার দেখাও, হারবাল ট্রিটমেন্ট করো, হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাও, দোয়া দরূদ, তাবিজ-কবজ—আরও কত কী।
সারাজীবন আমার কী করা উচিত তা তো আমার শুভাকাঙ্খীরাই নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাই আমার আসলেই কী করা উচিত, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমার ঠিক ছিল না।
এতদিনে বুঝলাম আমার সব ভালোই আসলে ভালো ছিল না। চারিদিকে নানা কথা শুনতে পেলাম। কেউ বলে, স্বার্থপরের মতো নিজের পড়াশোনা, চাকরি-বাকরি এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকলে বাচ্চা-কাচ্চা হবে কেমন করে? সব কিছুর একটা সময় নেই? কেউ বলে, এত ভালো হয়ে কী লাভ হলো? একটা বাচ্চা না হলে জীবনের আর কী থাকলো? অনেকেই আমাকে দেখে চুক চুক করে দুঃখ প্রকাশ করে, আর নিন্দুকেরা বলে, “বলেছিলাম না, বেশি ভালো ভালো না।”
কোনো এক জাদুবলে রাতারাতি আমার এত কষ্টের উপার্জিত ভালোত্ব চোখের সামনে ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে এবং আমার কিছু করার কোনো ক্ষমতাই এখানে নেই।
সারাজীবন যেমন সমাজের বেঁধে দেওয়া সংজ্ঞা অনুসারে ভালো হবার চেষ্টা করেছি, এখনো ঠিক তেমনভাবে সবার বুদ্ধি অনুসারে একটা বাচ্চা হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। অবশেষে টানা তিন বছর চেষ্টার পর আইভিএফ ট্রিটমেন্টের শরণাপন্ন হলাম। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে পরপর দুইবার নিষ্ফল হলাম। প্রত্যেকবারই এক-দুই সপ্তাহের মধ্যেই মিসক্যারেজ হয়ে গেল।
এদেশে দুইবারের বেশি সরকারি খরচে আইভিএফের ট্রিটমেন্ট হয় না। এর পর নিজের খরচে প্রাইভেটে আইভিএফ করাতে চাইলে করা যায়। শুভাকাঙ্খীদের প্রতিনিয়ত উপদেশ—অমুকে আইভিএফ করে পাঁচবারে সফল হয়েছে তো তমুকে সাতবারে। চেষ্টা করতে থাকো। কেউ আবার বলে, টাকা-পয়সা আয় করছ কিসের জন্য? নিজের ফুর্তির জন্য? বরং টাকা-পয়সা ট্রিটমেন্টে কাজে লাগাও। আখেরে ভালো হবে।
তাই তো, আখেরে যদি ভালো হয়? ভালোর পিছে ছুটাই তো আমার কাজ। এতে আমার কোনো ক্লান্তি নেই। দুই বছর আবার অনেকের বুদ্ধিতে নানা ওষুধ, হারবাল, প্রাকৃতিক পন্থা চেষ্টার পর আবারও প্রাইভেটে আইভিএফ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এবারও ট্রিটমেন্ট কাজে দিল না। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন ছয় মাসের আগে আর আইভিএফ করা ঠিক হবে না। তবে বছরখানেক বিরতি দিলেই মনে হয় ভালো। আমার বয়স তো বেড়ে যাচ্ছে। প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। এবারই মনে হয় শেষ চেষ্টা। অনেকেই বুদ্ধি দিলেন যে এক বছর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
ছয় মাসের মাথায় আবারও চেষ্টা করলাম। প্রতিবার এক-দুই সপ্তাহের মধ্যেই মিসক্যারেজ হয়ে যেত। এবার আট সপ্তাহ হয়ে গেল। সব তো মনে হয় ঠিকমতোই চলছে। কিন্তু হঠাৎ করে আমি যেন নতুন একটা ব্যাপার উপলব্ধি করলাম। এই ভালোর পিছে ছুটে ছুটে আমি আসলে খুবই ক্লান্ত। যদিও ভাবি, কে বলেছে আমাকে ভালোর পিছে ছুটতে? কেউ তো বলেনি। আমি নিজেই ছুটেছি। তবুও আর যেন পারছি না। গত প্রায় দশ বছর ধরে এক সন্তান হওয়ার পেছনের শারীরিক আর মানসিক কষ্ট আমার ভালো হওয়ার শেষ বিন্দুমাত্র ইচ্ছাটাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে।
সত্যি কি আমি এক সন্তানের জন্য উন্মুখ হয়ে আছি? কোথায়? কখনও তো আমার একজন শিশুর জন্য মন কাঁদেনি। কখনও তো আমার নিজেকে একা লাগেনি। কখনও তো মনে হয়নি একজন সন্তান ছাড়া আমার জীবন শূন্য। তাহলে কেন নিজের সাথে নিজের এই ছলনা? শুধুমাত্র সমাজের চোখে ভালো সেজে মা হওয়ার চেষ্টা করা।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এবারও বাচ্চাটা মিসক্যারেজ হয়ে যাবে। এরপর এই বয়সে এসে আর চেষ্টার কোনো প্রশ্ন আসে না। ডাক্তাররাই নিরুৎসাহিত করছেন। এরপর সব কিছু ভালো করলেও এই অদ্ভুত সমাজে কারো কারো চোখেই আমি পাকাপাকিভাবে অপূর্ণ থেকে যাবো। এতেই হবে আমার পরিপূর্ণ মুক্তি। নতুন করে নিজেকে জানার চেষ্টা করবো, বুঝার চেষ্টা করবো, নিজের ইচ্ছার প্রাধান্য দেওয়া শিখবো, মুক্ত করবো নিজেকে এতদিনের বেছে নেওয়া পথ থেকে। যদিও মনে হয় চল্লিশটা বছর পার করে দিলাম। বড্ড দেরি করে ফেলেছি। মনে হয়, জীবনটাকে যদি আবার নতুন করে শুরু করতে পারতাম!
আজ আমি ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছি। কিছু টেস্ট করে ডাক্তারের সাথে কথা বলার কথা। সাথে আছে আমার স্বামী। আমার এই পুরোটা যাত্রায় সে আমার সহযোগিতা করে এসেছে। সেও যে আমার মতোই ভালো। আমার অবচেতন মন আশায় আছে টেস্টগুলোর রিপোর্ট দেখে প্রতিবারের মতো এবারও ডাক্তার আমাকে হতাশ করার খবর দেবেন। কিন্তু এবার আমি আর হতাশ হবো না। আমি হবো বন্ধনমুক্ত, আমি হবো স্বাধীন।
হঠাৎ, ডাক্তারের ডাকে আমার সম্বিৎ ফিরে এলো। মিষ্টি ডাক্তার মহিলাটি মনোযোগের সাথে আমার সব রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করে হাসিমুখে জানালেন, সব কিছু খুবই পজিটিভ মনে হচ্ছে। এই আট সপ্তাহে বাচ্চার গ্রোথ, আমার স্বাস্থ্য সব কিছু একদম চমৎকার এগোচ্ছে। এরপর অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে আগের মতো এবার মিসক্যারেজ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
আমার কী কী করণীয় সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে আগামী অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করতে বলে আমাদের অভিনন্দন জানিয়ে বিদায় দিলেন সেই ডাক্তার। গাড়িতে ফিরে আমার স্বামী আমার দিকে তাকিয়ে আমার হাত ধরে চমৎকার এক হাসি দিলেন—ভালোবাসার হাসি, প্রাপ্তির হাসি, এতদিনের কষ্টের নিষ্পত্তির হাসি। গাড়িতে বাকিটা পথ আমার দু’চোখ দিয়ে ক্রমাগত অশ্রু ঝরতে লাগলো। আমার স্বামী আমাকে কাঁদতে দিলেন। আনন্দের কান্নায় বাঁধা দিতে নেই।
কিন্তু আমি কী করে বুঝাই, এ যে ঠিক আনন্দের কান্না নয়। আমি কেঁদেই চললাম। আমার মনে হলো, জীবনটাকে নতুন করে শুরু করা আর হলো না। ভালোত্বের বন্ধন থেকে এ জীবনে আর নিজেকে মুক্ত করা হলো না।
© আমিনা তাবাসসুম