মোবাইল ফোনে গুগল ম্যাপের নির্দেশনা অনুযায়ী সকাল বেলা গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাচ্ছিলাম। এত অনায়াসে গাড়ি চালিয়ে লন্ডন শহরের মাঝখানে অফিসে যাওয়ার সুযোগ হবে, তা কোনোদিন কল্পনাও করিনি। সাধারণ সময়ে ট্রেনে করে অফিসে যাতায়াত করি। গাড়ি নেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। প্রথমত, লন্ডন শহরের ট্রাফিক ভয়াবহ, দ্বিতীয়ত অফিসের কাছে কোনো পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। তার উপর কনজেশ্চন চার্জ, লো এমিশন জোন চার্জ—নানান ঝামেলা। কিন্তু এখন তো আর সাধারণ সময় নয়। করোনার এই সময়ে ‘কি ওয়ার্কার’-দের যাতায়াতের সুবিধার জন্য অফিসের কাছে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সব চার্জও মওকুফ। রাস্তাঘাটও একেবারে ফাঁকা। একটানে ৪৫ মিনিটে অফিসের সামনে পৌঁছে যাওয়া যায়।
এই পথে খুব একটা গাড়ি চালানো হয় না বলে গুগলের নির্দেশনার উপর ভরসা করে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালাতে ভালোই লাগছিলো, কিন্তু চোখে যেন রাজ্যের ঘুম নেমে আসছে। রোজার সময় সেহেরির জন্য উঠার কারণে রাতে সাধারণত কম ঘুম হয়। এ কারণে গাড়ি চালাতে গেলেই ঘুম আসে। বিবিসি রেডিওটা বেশ জোরে ছেড়ে দিয়ে মনোযোগ সরানোর চেষ্টা করছিলাম। এতে যদি ঘুম তাড়ানো যায়। আর বেশিদূর রাস্তা বাকি নেই। গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছে একটু সামনে গিয়ে ডানের গলিতে ঢুকলেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাবো। জায়গাটা খুব একটা পরিচিত মনে হচ্ছিল না। অনেক কষ্টে চোখ খুলে ডানের রাস্তাটা নিতে গুগলের চিরপরিচিত কণ্ঠ শুনলাম: “ইউ হ্যাভ রিচড ইওর ডেস্টিনেশন।”
ওমা! কোথায় নিয়ে আসলো গুগল আমাকে? এ তো দেখা যাচ্ছে একটা আবাসিক এলাকা। ঘিঞ্জি সারিসারি বাড়িগুলোর মধ্যে অযত্ন আর দৈন্যের ছাপ সুস্পষ্ট। আমি কি ম্যাপে ভুল ঠিকানা দিয়েছিলাম? হতে পারে। গাড়ির ড্যাশবোর্ডের স্ট্যান্ড থেকে মোবাইল ফোনটা খুলে দেখে নিলাম—ম্যাপে আমার অফিসের ঠিকানাই দেওয়া। আর গুগল দেখাচ্ছে, গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে আরও বিশ মিনিট বাকি। তাহলে এইমাত্র বলল গন্তব্যে পৌঁছেছি? কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। গুগল ম্যাপের হিস্ট্রি ঘেঁটে দেখলাম, অন্য কোনো ঠিকানা ব্যবহার করা হয়নি। যাই হোক, ঠিক নয়টায় মিটিং ধরতে হবে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। ম্যাপের নির্দেশনা অনুযায়ী রওনা দিতে গিয়ে সামনের বাড়িটির জানালায় চোখ আটকে গেলো। তিন-চার বছরের একটি মিষ্টি ছেলে জানালায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। গাড়ি থেকেও পরিষ্কার তার মুখ দেখা যাচ্ছে। কোঁকড়া চুল, বিশাল দুটো চোখ, আর মিষ্টি মুখটাতে ভয় আর অসহায়ত্ব খেলা করছে। আমাকে দেখে সে হাত নাড়ল। মনে হলো ডাকছে। নাকি “হাই” জানাচ্ছে? আমিও হাত নাড়িয়ে হাই জানালাম। তাড়াতাড়ি চলে এলাম। নাহ, গুগল ম্যাপ এবার আমাকে ঠিক অফিসেই এনেছে। তখন মনে হলো ঘুমের ঘোরে ভুল বুঝেছিলাম।
অফিসে সারাটা দিন খুব ব্যস্ততায় কেটে গেল। হাতে আরও কিছু কাজ ছিল, কিন্তু ঘড়িতে ঠিক পাঁচটা বাজতেই ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলাম। খুব ক্লান্ত লাগছিল। জীবাণুনাশক দিয়ে ভালোভাবে ল্যাপটপ, মাউস—সবকিছু মুছে ব্যাগে ভরে হাত ধুয়ে বের হতে আরও কিছু সময় লেগে গেল। গাড়িতে এসে যথারীতি গুগল ম্যাপে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বিবিসি রেডিও শুনতে শুনতে যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু কী মুশকিল, ঘুমে চোখদুটো একদম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। জোরে গান ছেড়ে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গান গেয়ে ঘুম তাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করার পর বুঝলাম, এভাবে গাড়ি চালানো ঠিক নয়। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তাই বড় রাস্তা থেকে নেমে সামনের গলিতে গিয়ে কোথাও গাড়ি পার্ক করে মিনিট পনেরোর জন্য পাওয়ার ন্যাপ নেওয়ার চিন্তা করলাম। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। সামনের বামের গলিতে ঢুকেই একটা ছায়ায় গাড়ি পার্ক করলাম। চোখটা একটু বন্ধ করতে যাব, সেই মুহূর্তে চোখে পড়ল সামনের বাসাটা। আরে! এ তো সেই সকাল বেলার বাসাটা! বাড়ির সামনের বাদামি রঙের দরজাটার হাতলটা একটু ভাঙা, তার পাশেই দেয়াল ঘেঁষে অযত্নে বেড়ে ওঠা একটা গাছে অপূর্ব বেগুনি রঙের ফুল ফোটা। তার পাশেই বাড়িটির লিভিং রুমের বিশাল জানালা। কী আশ্চর্য, এখনো সেই ছেলেটা ঠিক আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে আবারও আমাকে হাত নেড়ে ইশারা করছে। তার চোখে-মুখে কেমন একটা মরিয়া ভাব। বুকের মধ্যে একটা ভয় চেপে বসলো। বারবার আমি এই বাড়ির সামনেই এসে পড়ছি কেন? নিজের মনেই বললাম, এটা কোনো ব্যাপার নয়। ঘুম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অবচেতন মন সহজ একটা পার্কিং স্পট খুঁজে এখানে নিয়ে এসেছে।
পাওয়ার ন্যাপ আর নেওয়া হলো না। কোনো এক কারণে ঘুম একেবারে কেটে গেল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কিছুতেই সেই ছোট্ট ছেলেটার মিষ্টি মুখটা মন থেকে সরাতে পারছিলাম না। কী যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল ছেলেটার দৃষ্টিতে। এই লকডাউনের মধ্যে বাচ্চারা বোধহয় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। মনে হলো, ওর মতো বাচ্চারা সারাটা দিন জানালায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখে আর পথচারীদের হাত নেড়ে “হাই” জানিয়েই কাটায়। বাড়িতে এসে ছেলেটার কথা ভুলে গেলাম। এরপর কয়েকদিন অফিস যাওয়ার পথে ঘুম বা গুগল ম্যাপ, কোনোটাই আর ঝামেলা করেনি।
এক সপ্তাহ পরের কথা। টিভিতে রাত দশটার খবর দেখছিলাম। হঠাৎ একটা দৃশ্যে আমার হৃদস্পন্দন একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। টেলিভিশনের স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে সেই বাড়ি। অবিকল সেই বাড়ি। শুধু চারদিকে পুলিশ আর ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য ফ্লুরোসেন্ট টেপ লাগানো। কয়েক সেকেন্ড পর স্ক্রিনে সেই ছেলেটার মায়াময় মুখের ছবি দেখানো হলো। খবরটা পুরোপুরি বোঝার মতো মানসিক অবস্থা তখন আমার ছিল না। যা বুঝলাম, তিন-চার বছরের এই ছেলেটি মুক, বধির এবং মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী ছিল। সে তার মায়ের সঙ্গে একা ওই বাড়িতে থাকত। ধারণা করা হচ্ছে, এক সপ্তাহ আগে ছেলেটির মা করোনায় আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্টে বাড়িতেই মারা গিয়েছিলেন।
করোনা হেল্পলাইনে দুই সপ্তাহ আগে তিনি যোগাযোগ করেছিলেন। তখন তার অবস্থা ভালো থাকায় বাড়িতে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এরপর তার অবস্থার অবনতি হলো, কিন্তু কেন তিনি আবার সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করেননি, তা এখনও পরিষ্কার নয়। আর সেই শিশু, মায়ের মৃত্যুর পর একা বাড়িতে থেকে খাবার ও পানির অভাবে তিন-চার দিন আগে মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশের বাড়ির প্রতিবেশীরা যখন শিশুটির সচরাচর স্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেনি, তখনই পুলিশে খবর দেয়।
খবরটা দেখে আমি কী করব, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ফোন ঘেঁটে সেই দিনের গুগল ম্যাপের হিস্ট্রিতে সেই বাড়ির কোনো ঠিকানা আছে কিনা আবার খুঁজে দেখলাম। না, কিছুই নেই। খবরে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী আনুমানিক সেই দিন বা তার আগের দিন ছেলেটির মা মারা গিয়েছিল। আসলেই কি আমি সেই বাড়ির সামনে গিয়েছিলাম, নাকি পুরোটাই আমার অবচেতন মনের কল্পনা? এক সপ্তাহ আগের কল্পনায় কেমন করে আমি এই বাড়ি আর ছেলেটিকে দেখতে পেলাম? আর যদি সত্যিই সেই বাড়ির সামনেই গিয়ে থাকি, তাহলে কি আমি ছেলেটিকে বাঁচাতে পারতাম? ছেলেটি তো বারবার হাত নেড়ে চোখের ইশারায় আমার সাহায্য চেয়েছিল। আমি এটা কী করলাম!
এরপর কিছুদিন যেন ঘোরের মধ্যে কাটল। কী হলো, কেন হলো, আর আমি কি সত্যিই ছেলেটিকে বাঁচাতে পারতাম—এসব চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। এমনকি পুলিশকে যোগাযোগ করে সব খুলে বললাম। বাড়িটি আসলেই আমার অফিস থেকে ২০ মিনিটের মতো দূরে অবস্থিত। তারা সব শুনে, ভেবে চিন্তে এটাকে কাকতালীয় ব্যাপার বলে উড়িয়ে দিল। এখানে আমার নাকি কিছুই করার ছিল না। আমি অথবা বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া কারও পক্ষেই নাকি ব্যাপারটা আঁচ করা সম্ভব ছিল না।
ধীরে ধীরে আমি নিজের জীবন নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু এখনও মাঝে মাঝে সেই ছেলেটার মিষ্টি মুখখানি মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। প্রকৃতি তার রহস্যময় খেলায় কোনো এক কারণে আমাকে সেই ছেলেটির সামনে দাঁড় করিয়েছিল। মনে হয় খেলা দেখতে—আমি কী করি? আমি সেই খেলায় হেরে গেছি। ভীষণভাবে হেরে গেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আরেকবার যদি সেই খেলাটার সুযোগ পেতাম, আর মাত্র একবার, তাহলে জিতে গিয়ে এবার দেখিয়ে দিতাম। পরাজয়ের এই বোঝাটা মাঝে মাঝে খুব ভারী মনে হয়।
© আমিনা তাবাস্সুম