Ameena Tabassum

আমার আছে নদী

(১)
কতজনের কত কিছুই না হবার সাধ জাগে। আকাশ, মেঘ, নদী, ঝর্ণা, সাগর, পাহাড়, অরণ্য—এরকম কত কিছু। আমার ইচ্ছা করে নদী হতে। আর যেকোনো নদী না, শুধু টেমস নদী। যেই নদী আমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী, সেই নদীর সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা করে।

টেমস নদীর সাথে আমার একটা বিশেষ বন্ধন আছে, একেবারে আত্মার বন্ধন। আমার বাসা নদীটির একেবারে কাছেই। ইংল্যান্ডের হ্যাম্পটন কোর্ট প্যালেসের কথা শুনেছেন? বহুবিবাহের জন্য প্রখ্যাত বা কুখ্যাত ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি দ্য এইট্থের প্রাসাদ ছিল এটা। একেবারে টেমস নদীর উপরেই এই প্রাসাদ। সেই প্রাসাদ থেকে নদীর তীর ধরে উজানের দিকে (upstream) মিনিট পনেরো হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যায় আমার এলাকায়।

ওয়েস্ট মোলসি নামের ছোট্ট বৈচিত্র্যহীন সেই এলাকা। ট্যুরিস্টে ঠাসা হ্যাম্পটন কোর্ট প্যালেস, এর সাথেকার চাকচিক্যময় হ্যাম্পটন কোর্ট ব্রিজ আর আশেপাশের ঝলমলে রেস্তোরার মাদক আবেদনের পাশে আমার এই ছোট্ট এলাকাটি বড়ই অনাড়ম্বর, ভীষণ সাদামাটা। তবু আমার কী যে প্রিয় এই জায়গাটা!

কেননা লন্ডনের শহরগুলো পার করে, হ্যাম্পটন কোর্ট প্যালেস ছেড়ে, আমার টেমস নদী আমার এলাকায় এসে যেন রাজকীয় সাজসজ্জা ত্যাগ করে স্বমূর্তি ধারণ করে। কোনো ধরনের মেকআপবিহীন সদ্যস্নাত টেমস যেন আমাকে চুম্বকের মতো টানে।

আমার বাসা থেকে যদিও ঠিক নদী দেখা যায় না, কিন্তু মিনিট পাঁচেকও হাঁটতে হয় না, তার আগেই পৌঁছে যেতে পারি আমার নদীর তীরে। অবলোকন করতে পারি এর সৌন্দর্য। কিন্তু শুধু দেখেই কি আর সাধ মেটে? এর গভীর রহস্য কি বোঝা সম্ভব? আমার তো মনে হয় না। আমার তো নিজেকে বিলীন করে দিতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে নদী হতে।

কাকতালীয়ভাবে আমার অফিসও টেমসের পাশে। লন্ডন ওয়াটারলু, যেখানে টেমস একেবারে সম্রাজ্ঞীর রূপ ধারণ করে যেন সিংহাসনে আসীন। সারাদিন, রাতভর তার সেই রূপে বিমুগ্ধ দর্শকরা চেয়ে থাকে তার দিকে। তার রূপে যেন ঘোর লেগে যায় দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের।

আমি তো কোনোদিন লাঞ্চ টাইমে আধঘণ্টা হাতে পেলেই ছুটে যেতাম তার পাশে, একটু জুড়িয়ে নিতাম আমার মন, প্রাণ। কিন্তু অনেকদিন দেখা হয় না আমার নদীর সেই সম্রাজ্ঞী রূপ। আমার যে অফিসে যাওয়া নিষেধ।

সেই যে কবে ম্যাটারনিটি লিভে অফিস ছেড়েছি, আর ফিরে যাওয়া হয়নি। যদিও আমার ফুটফুটে মেয়েটি পৃথিবীর রূপটা দেখতে না দেখতেই হারিয়ে গেল, কিন্তু আমার ছুটি যেন আর শেষ হয় না।

ডাক্তার বলেছে আমি নাকি কাজে ফিরে যাবার অযোগ্য। আমার নাকি অসুখ—পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার দিয়ে শুরু। এখন ডিপ্রেশন, সোশ্যাল এঞ্জাইটি থেকে শুরু করে আমার মধ্যে নাকি বাইপোলার ডিজঅর্ডারও দেখা দিয়েছে।
মেয়েটাকে হারানোর শোক আমি নাকি নিতে পারিনি। আমার নাকি চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু আমি জানি, আমার কিছুই হয়নি। আমি দিব্যি আছি। মাঝে মাঝে আমি খুশিতে দিশেহারা হয়ে যাই। রান্না করি, ঘর গুছাই, মন ভরে সাজগোজ করে বসে থাকি।

কিন্তু অ্যালেক্সটা যে কী, আমার এসব দেখে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। ও ভাবে আমি কিছুই বুঝি না। কিন্তু আমি ঠিকই ওর সব বুঝতে পারি।

মাত্র তিন মাস ডেট করেই আমি অ্যালেক্সকে বিয়ে করেছিলাম। এর বেশি সময় লাগেনি আমাদের। কেননা তিন মাসেই আমরা দুজন দুজনকে বুঝে গিয়েছিলাম, ভালোবেসেছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম।

কিন্তু অ্যালেক্স যেন আমাকে আর বুঝতে পারে না। আমি যা করি, সবকিছুতেই সে কাঁদে, অস্থির হয়ে যায়। আসলে চিকিৎসা আমার দরকার না, চিকিৎসা ওর দরকার। ছেলেটা কেমন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ওর দিকে যেন আর তাকানো যায় না।

তবে আমার এই খুশির ভাবটা বেশি থাকে না। প্রায়ই আমি দিনের পর দিন শুধু কেঁদে কাটিয়ে দেই। কাঁদতেও আমার খারাপ লাগে না। কিন্তু অ্যালেক্স আমার কান্না দেখেও মন খারাপ করে। ওকে আমি বোঝাতে পারি না যে কাঁদতে আমার ভালো লাগে। মনে হয় আমার চোখে নদী আছে।

যদিও আমার অফিসের কাছের টেমসের সম্রাজ্ঞী রূপ আমি মিস করি, কিন্তু আমার বাড়ির কাছের টেমসই আমার বেশি প্রিয়। এই সাধারণ, এই অনাড়ম্বর নদীই আমাকে যেন বেশি টানে।

মনে হয় অতি সাধারণের একটা অসাধারণত্ব আছে। আমি সেই সাধারণ অসাধারণে একেবারে বুঁদ হয়ে যাই। আমি বুঝে যাই যে এই নদীই আমার আপন, আমার ঠিকানা, আমার ডেস্টিনি।

অ্যালেক্স জানে যে নদী আমার কত প্রিয়। তাই অফিসের পর বাড়ি ফিরে প্রায়ই আমাকে নিয়ে নদীর ধারে হাঁটতে বের হয়।

দিনের বেলায় আমার সাথে বাড়িতে একজন নার্স থাকে। কোনো নার্সের দরকার নেই আমার, সব অ্যালেক্সের বাড়াবাড়ি। আমি সারাদিন অ্যালেক্সের পথ চেয়ে বসে থাকি। কখন ও ফিরবে? কখন আমি নদীর কাছে যাব?

নদীর ধারে গেলেই আমি আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়েটার কথা শুনতে পাই। আমি বুঝতে পারি যে আমার মেয়েটা আমাকে ডাকছে।

নদীর দিকে মন দিয়ে কান পেতে রাখলেই আমি বুঝতে পারি, ওকে শুনতে পাই। আমি অ্যালেক্সকে ব্যাপারটা বলিনি। বললে যদি ও আমাকে নদীর কাছে না নিয়ে আসে?

কিন্তু অ্যালেক্সের যন্ত্রণায় মেয়েটিকে ভালো করে খুঁজে দেখতে পারি না। অ্যালেক্স আমাকে পুরোটা সময় চোখে চোখে রাখে, আমাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাঁটে। আমার ভালো লাগে না।

আমার নদীর উপর কান পেতে মেয়েটাকে ভালোভাবে শুনতে ইচ্ছা করে, কিন্তু অ্যালেক্সের জন্য পারি না। আমার হাঁসফাঁস লাগে।

(২)

আমার মা আর ছোটবোন গতকাল বেড়াতে এসেছে। একেবারে গাট্টি-বোঁচকা বেঁধে হাজির হয়েছে দেখি, কয়েকদিন নাকি আমার সাথে থাকবে। অ্যালেক্সকে ওরা জোরাজুরি করছে যে কিছুদিন ওর বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে হাওয়া বদল করে আসতে। অ্যালেক্স এই সপ্তাহটা আমার সাথে কাটানোর জন্য ছুটি নিয়েছিল।

কিন্তু আমার মায়ের ধারণা, আমার দেখভাল করতে করতে অ্যালেক্স নাকি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। ওর একটু ব্রেক দরকার। আমার তো মনে হয় ওর আসলেই ব্রেক দরকার। ওর দরকার হাওয়া বদল। অসুস্থ তো আসলে আমি না, অসুস্থ তো অ্যালেক্স। কিন্তু ব্যাপারটা এদের বোঝায় কে?

অ্যালেক্স কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছিল না। আমাকে নাকি ওরা কেউ ঠিকঠাক দেখে রাখতে পারবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার মা আর বোন দুইজন মিলে বুঝিয়ে ওকে রাজি করিয়েছে। মাত্র তিনদিন ও বাবামায়ের সাথে কাটিয়ে আসবে। আর আমিও ওকে কথা দিয়েছি যে আমি একেবারে লক্ষ্মী মেয়েটির মতো থাকব।

যাবার সময় তো অ্যালেক্স কেঁদেকেটে আমাকে চুমু দিয়ে অস্থির করে দিলো। বার বার বলে গেলো যে ও আমাকে কত ভালোবাসে আর আমি যেন লক্ষ্মী মেয়ের মতো থাকি। বলেছিনা, অসুখটা আসলে ওর। তা না হলে মাত্র তিনদিনের জন্য কোথাও গেলে বউকে নিয়ে কেউ এতো পাগলামি করে?

অ্যালেক্স যাবার পর আমরা দুই বোন আর মা অনেক মজা করে গল্প করলাম। আমার কেন জানি ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন সেই ছোটবেলায় ফিরে গিয়েছি। আরেকটা কারণে ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। অনেকদিন পর একটু একা একা ঘুমানোর জন্য মনটা অস্থির হয়ে আছে।

অ্যালেক্স আমাকে যেভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকে, যে একটু আরাম করে স্বপ্ন দেখারও সুযোগ নেই। আর ওর ঘুম এত হালকা যে একটু এদিক-ওদিক করলেই ও উঠে অস্থির হয়ে যায়।

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় একজন আমার সাথে ঘুমাতে চাইলো। আমি বললাম একেবারে অসম্ভব। মায়ের নাক ডাকা তো আমি সহ্যই করতে পারব না আর বোন এমন হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে যে ওর সাথে আমি ছোটবেলায়ই এক বিছানায় কখনো ঘুমাতে পারিনি। এখন তো কিছুতেই পারব না।

আমরা তিনজন আবার ছোটবেলার কিছু ঘটনা নিয়ে হাসাহাসি করে আলাদা রুমে ঘুমাতে চলে এলাম। আমি জানি উত্তেজনায় আজকে আমার একটুও ঘুম হবে না। আমার মা আর আমাদের দুই বোনের ঘুম সবসময়ই খুবই গাঢ়। বাড়িতে ডাকাত পড়লেও আমাদের ঘুম ভাঙে না।

ওদের ঘুম ঠিক আগের মতোই আছে। শুধু বদলে গিয়েছি আমি। আমরা রাত দশটার দিকে ঘুমাতে এসেছি কিন্তু প্রায় চার ঘণ্টার মতো আমি টানটান হয়ে শুয়েছিলাম। উত্তেজনায় এক মুহূর্তের জন্য চোখের দুই পাতা এক করতে পারিনি।

এরপর খুব ধীরে ধীরে উঠে আস্তে করে নিচের তলায় নেমে এলাম। বাড়ির পেছনের দিকের দরজাটা খুলে খুব সহজেই কোনো শব্দ না করে গার্ডেনে বেরিয়ে এলাম।

হঠাৎ মনে হলো ওভারকোটটা পরতে ভুলে গিয়েছি। আমার পরনে শুধু হালকা রাত পোশাক। কিন্তু খুব একটা ঠান্ডা লাগছে না। নভেম্বর মাসের তুলনায় ঠান্ডাটা যেন একটু কমই।

এই সময়টায় ইংল্যান্ডের প্রকৃতি এক মাদক রূপ ধারণ করে। অর্ধনগ্ন গাছগুলোতে এখনো কিছু লাল-কমলা পাতার সমারোহ আর বাকিসব পাতা ঝরে পড়ে যেন লাল-কমলার নকশাকরা কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে।

হঠাৎ আমার বিশাল চাঁদের দিকে চোখ পড়লো। সেই চাঁদের আলোর কারণে এই গভীর রাতেও প্রকৃতির লাল-কমলা রূপ ফুটে উঠেছে। আজ কি পূর্ণিমা?

আমি সন্তর্পণে গার্ডেনের শেষ মাথার বেড়ার সাথে থাকা ছোট্ট দরজাটা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। চাঁদের আলোয় প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতেই নদীর ধারে চলে এলাম।

ইশ! কী যে সুন্দর। চাঁদের আলোয় যেন একেবারে স্বর্গের পরী সেজে বসে আছে আমার নদী। কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার। এখানে কেউ নেই, অ্যালেক্স নেই, কোনো কাকপক্ষীও নেই, আজ কেউ আমাকে বাধা দেওয়ার নেই। আমি আজ আমার মেয়েটির কথা মন ভরে শুনবো, ওকে ছুঁয়ে দেখবো।

আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের রাত। আমি নদীর একেবারে ধারে ঘাসের উপর বসে পড়লাম, পা ঝুলিয়ে নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে দিলাম। ইশ! কী ঠান্ডা পানি।

আমার মেয়েটারও নিশ্চয়ই ঠান্ডা লাগছে। আমি অধীর আগ্রহে নদীর গভীরে চোখ রেখে, কান পেতে বসে থাকলাম। কয়েক মুহূর্তের পিনপতন নীরবতা।

তারপর ধীরে ধীরে কোথা থেকে যেন গান ভেসে আসছে। ছোট্ট একটা মেয়ে গান গাইছে,
“Row, row, row your boat, gently down the stream,
Merrily, merrily, merrily, merrily, life is but a dream.”
ওই তো একেবারে নদীর গভীর থেকে গানটা ভেসে আসছে। আমি পরিষ্কার শুনতে পারছি। কী মিষ্টি একটা ছোট্ট মেয়ের গলা।

আর যেন একটা সূক্ষ্ম আলোর রশ্মিও নদী থেকে বের হয়ে আসছে। ওখানেই আমার মেয়েটা আছে নিশ্চয়ই, আমার নদীর গভীরে, আমার নদীর সাথে বিলীন হয়ে আছে। আজ আমার ওকে ছুঁতেই হবে।
আমিও ওর সাথে গলা মিলালাম,

“Merrily, merrily, merrily, merrily, life is but a dream.”
আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের রাত। আজ আমি নদী হবো।

© আমিনা তাবাস্সুম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top