Ameena Tabassum

আমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে

আমি আর আমার এক্স-হাসবেন্ড মুখোমুখি বসে আছি একটা কফি শপে। কফি অর্ডার করা হয়েছে আর আমরা বসে আছি সেই কফির প্রতীক্ষায়। আমাদের প্রায়ই নানান দরকারে কথা হয়, দেখা হয়। কিন্তু আমাদের ছাড়াছাড়ি হবার পর কখনো একসাথে কফি খেতে আসা হয়নি, এই প্রথম। ভেবেছিলাম ব্যাপারটা একটু অস্বস্তিকর হবে। কিন্তু মনে হচ্ছে আমরা কেউই অস্বস্তি বোধ করছিনা। মনে হচ্ছে আগে যেমন সুযোগ পেলেই আমরা দুজনে মিলে কফি খেতে বের হতাম, আজকেও ঠিক সেরকম এসেছি।

আজ আমাদের বড় ছেলের গ্র্যাজুয়েশনের অনুষ্ঠান ছিল। সেই উপলক্ষে সারাদিনের জন্য একসাথে হওয়া। সকাল সকাল ইংল্যান্ডের দুই প্রান্ত থেকে দুজনে ছেলের ইউনিভার্সিটিতে হাজির। দুপুরে অনুষ্ঠান ছিল। বিকালের পর ছোট ছেলেও তার ইউনিভার্সিটির শহর থেকে এসে হাজির হবে। তারপর সবাই একসাথে ডিনার করবো। মূল অনুষ্ঠানে মাত্র দুইজন গেস্টের টিকেটের ব্যবস্থা করা গেলো দেখে শুধু বাবা আর মা নিমন্ত্রণ পেয়েছে। ছোট ভাই পেয়েছে রাতের ডিনারের নিমন্ত্রণ। অনুষ্ঠানের পর আমাদের নতুন গ্র্যাজুয়েট ছেলের বিকেলটা বন্ধুবান্ধবের সাথে কাটানোর পরিকল্পনা দেখে আমাদের অগত্যা এই কফি শপে বসে সময় কাটানো। ছোট ছেলে এসে পৌঁছানো না পর্যন্ত আমাদের আপাতত এখানেই থাকার পরিকল্পনা।

আমরা দুজনেই ছেলের গ্র্যাজুয়েশন উপলক্ষে বেশ সেজেগুজে আছি। আমার পরনে কালো সুতির জমিনের উপর সাদা সুতার সূক্ষ্ম কিন্তু ভরাট কাজ করা জামদানি শাড়ি। সাথে রং মিলিয়ে সাদা-কালো শেডের হিজাব। সাথে আমার প্রিয় বড় বড় মুক্তার লম্বা মালাটি পরার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আলসেমি করে মালাটা বের করে আর পরা হয়নি। অনেকদিন পর আজ একটু সাজলাম, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে এই সাজগোজ। কিন্তু এতদিন পর হঠাৎ নিজেকে একটু পরিপাটি করে তুলতে পেরে মন্দ লাগছেনা। মনে হচ্ছে, সবসময় বৈরাগ্য রূপ না ধরে থেকে মাঝে মাঝে না হয় একটু সাজলেই পারি। আমি সুন্দর হয়ে থাকলেও কিছু ক্ষতি হবেনা আর বিশ্রী হয়ে থাকলেও কিছু লাভ হবেনা। জীবন বয়ে চলবে জীবনের মতন, যেই জীবনের উপর আমার কোনো হাত নেই। শুধু আমার কেন, এই পৃথিবীতে কারোরই হাত নেই। তবে এই যে আজ আমি ছেলের অনুষ্ঠানে একটু সেজেগুজে এসেছি, ছেলেটা আমাকে দেখে যে কী খুশি হয়েছে তা বলার না। বার বার বলছে মা তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আকাশ থেকে এঞ্জেল নেমে এসেছে। জানি কথাটা আমাকে খুশি করার জন্য বানিয়ে বানিয়ে বলা। তবে কথাটা বানানো হতে পারে কিন্তু ছেলেটার খুশির প্রকাশে বিন্দুমাত্র খাদ নেই।

আমি একটু মনোযোগ দিয়েই ওকে দেখার চেষ্টা করলাম। ছেলের গ্রাজুয়েশন উপলক্ষে দেখি ভালোই সাজ দিয়েছে। ধবধবে সাদা শার্ট আর কালো স্যুটের সাথে ওর নিজের ইউনিভার্সিটির ব্র্যান্ডের টাই, রুমাল আর কাফলিংক। মন মেজাজও অতিশয় উৎফুল্ল। সেই সকাল থেকে আমার দিকে তাকিয়ে এক হাসি দিচ্ছে, আনন্দের হাসি, প্রাপ্তির হাসি। হাসি দিয়ে যেন বুঝাতে চাচ্ছে, “বলেছিলাম না যে সব ঠিক হয়ে যাবে?” সেই হাসি দেখে আমার খুব একটা আনন্দ হচ্ছেনা বরং মনটা বিষাদে ভরে যাচ্ছে।

এরকম তো হবার কথা না। আসলেই তো সব ঠিক হয়ে গেছে। যা চেয়েছিলাম তাই হয়েছে। আমার ছোট ছেলেটা আল্লাহর রহমতে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে। যেই আশা একসময় যেন ছেড়েই দিয়েছিলাম। নাহ, আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম বললে ভুল হবে। আশার নিভু নিভু প্রদীপটা জীবনের সবটুকু শক্তি দিয়ে আগলে রেখেছিলাম। এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেইনি। পাছে একটু ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকে নিভিয়ে দেয় সেই প্রদীপটাকে। সেই প্রদীপটাকে জ্বালিয়ে রাখা নিয়ে এত আকুল ছিলাম যে জীবনের বাকি প্রদীপ যে নিভে যাচ্ছে তা নিয়ে কোনো দৃক্পাতই আমার হয়নি।

সবাই আমাকে বলতো যে ডাক্তাররা যা করার সব করছে আর আমরাও আমাদের চেষ্টা করে যাচ্ছি, বাকিটা আল্লাহর হাতে। আর এর মধ্যেই আমার ভালো থাকতে হবে, বেঁচে থাকতে হবে, সুস্থ থাকতে হবে। যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হবে। আমার নিজের জন্য না হলেও, অসুস্থ ছেলেটার জন্য আর আমার বড় ছেলেটার জন্য।

কিন্তু তখন কি আমার স্বাভাবিক জীবনযাপন করার সময় ছিল? নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় ছিল? ভালো থাকার সময় ছিল? কিন্তু কেউ আমার ব্যাপারটা বুঝতে চায়নি। সবার এক কথা। একটু ব্রেক নাও, নিজের জন্য কিছু করো, পরিবারের বাকিদের একটু সময় দাও। কেননা সবাই একসাথে ভালো থেকে এই লম্বা যুদ্ধ মোকাবিলা করতে হবে।

কিন্তু আমি পারিনি। তখন আমার ছিল মাথা-পাগল অবস্থা। আমি আমার অসুস্থ ছেলেটাকে নিয়ে ছিলাম দিশেহারা, সে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি যেন নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছিলাম না। হ্যাঁ, এই কারণে বড় ছেলেটা স্বাভাবিক জীবন থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হয়েছিল, আর ওদের বাবা অসুস্থ ছেলে আর তার সঙ্গে অস্থির আর ভারসাম্যহীন স্ত্রী নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিল।

আপনজনের অসুস্থতা যে কী কঠিন এক পরীক্ষা, যে এই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে কোনোদিন যায়নি, তার পক্ষে বোঝা সম্ভব না। তবে সেই পরীক্ষা কারও না দিতে হোক। চোখের সামনে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ছেলেটার কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। প্রতি মুহূর্তে আমি উপলব্ধি করতাম যে মানুষ কতটা অসহায়, কতটা ক্ষমতাহীন। নিজেকে যত অসহায় মনে হতো, আশপাশের আপনজনদের যেন তত অসহ্যকর মনে হতো। আর সেই অসহায়ত্বের মুহূর্তে আমার হাসবেন্ডের স্বাভাবিক জীবনযাপনের প্রচেষ্টা, ভালো থাকার ভান যেন আরও পীড়াদায়ক ছিল। আর ওর জন্য কষ্টের ছিল স্ত্রীর একটানা অস্থিরতা।

অক্ষমতা বড়ই নির্মম, সম্পর্কের সবচেয়ে দৃঢ় দেয়ালটাতেও ফাটল ধরিয়ে দেয়। জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সম্পর্কটাকেও দূরে ঠেলে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। আর মাঝে মাঝে এতো দূরে সরিয়ে দেয় যে সেই দূরত্ব ঘুচানো আর সম্ভব হয় না।
আমাদেরও ঠিক একই অবস্থা হয়েছিল। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে আমরা শুধু আমার ছেলেটার দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম না, আমাদের অক্ষমতার সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম। আর সেই যুদ্ধ মোকাবিলা করার কৌশল আমাদের দুজনের ছিল ভিন্ন। আমার ছিল অস্থিরতা দিয়ে কষ্ট ঢেকে রাখার চেষ্টা, আর ওর স্বাভাবিক থাকার ভান করে কষ্টকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা। আমরা কেউই আমাদের কৌশল ঠিকমতো প্রয়োগ করতে পারছিলাম না। কী করে পারবো? আমরা দুজনই নিজেদের কৌশল নিয়ে দিনরাত নিজেদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম। অবশেষে নিজেদের অবস্থানে অটল আমরা যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে নিজেদের পথ দেখলাম। বুঝতে পারলাম যে একসাথে থেকে সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করার ফলে অসুস্থ ছেলেটার যেমন অযত্ন হচ্ছে, তেমনি কষ্ট পাচ্ছে আমার বড় ছেলেটা।

তবে আমাদের এই সিদ্ধান্তে যে ছেলেদের কষ্ট বেশি নাকি কম হয়েছে, সেটা আমি বলতে পারবো না। তবে আমাদের সুবিধা হয়েছে। আমার চোখের সামনে আরেকজনের স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করার যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি, আর আরেকজনের সারাদিন অস্থির স্ত্রী মোকাবিলা করতে হয়নি। আমি জান দিয়ে আমার ছেলেটাকে আগলে রেখেছিলাম, আর সে তার মতো করে ছেলের জন্য সব করার চেষ্টা করে গেছে। আর বড়টাও বাবার সঙ্গে থাকাকালীন সময়গুলোতে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে। তবে আমাদের এই সিদ্ধান্তে অনেকেই অবাক হয়েছে। এখন কি আমাদের বিচ্ছেদের সময়? একটু কষ্ট একসাথে বয়ে বেড়ানোর ক্ষমতা আমাদের নেই? হয়তোবা তাই। তবে বাইরে থেকে কথা বলা অনেক সহজ; যে সেই কষ্টের ভেতর দিয়ে যায়, সেই জানে ব্যাপারটা কী।

আমার এখনো সেই সময়টার কথা চোখে ভাসে। বছর পাঁচেক হয়ে গেলো, কিন্তু মনে হয় এই তো গতকাল।
ও বলেছিলো,
—আমি এভাবে আর চলতে পারছি না। এই যুদ্ধ একদিনের না, আমাকে বেঁচে থাকতে হবে, সুস্থ থাকতে হবে, স্বাভাবিক থাকতে হবে। তা না হলে আমি ছেলেটাকে দেখবো কেমন করে? এই অস্বাভাবিক জীবন আমি আর নিতে পারছি না। আমরা একটু চেষ্টা করলেই দুজনে মিলে একসাথে কষ্টটা পার করতে পারবো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। শুধু আমাদের একটু স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে হবে।
স্বাভাবিক থাকার মানে কী তা আমার জানা। দিনরাত আমি শুনে এসেছি। আমার অসুস্থ ছেলেটাকে পাশে রেখে মাঝে মাঝে হাসতে হবে, বেড়াতে হবে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে হবে, আরও কত কী। আমি জানি আমার পক্ষে এটা সম্ভব না।
প্রথমে কিছুদিন আমরা আলাদা ছিলাম। একসময় ও আমাকে বলেছিলো যে আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আরেকবার আমি যাতে ভেবে দেখি। এত কঠিন কিছু আমাদের না করলেও চলবে। ও আমাকে আমার মায়ের কাছে ছেলেদের রেখে তিনদিনের জন্য বেড়াতে যাবার নিমন্ত্রণ করেছিল—নিজেদের সংশোধন করে একসাথে থাকতে পারি। আমি রাজি হইনি। আমার অসুস্থ ছেলেটাকে রেখে আমি বেড়াতে যাবো? যে এভাবে চিন্তা করতে পারে, তার সঙ্গে আমি থাকতেও চাই না।
আমাদের ডিভোর্সের পর আরও বছর তিনেক এই জীবনযুদ্ধ চলেছে। ধীরে ধীরে আমার ছেলেটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। দূরে থেকেও আমরা বিপদে আপদে একসাথে থেকেছি। সব আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ঠিক যা দোয়া করেছিলাম তাই—আমার ছেলেটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। আর কিছু চাওয়া-পাওয়া আমার নেই। আর কিছু চাওয়া আমার উচিত না।
টেবিলে কফি চলে এসেছে। ও খুশি হয়ে আমার দিকে কাপটা এগিয়ে দিচ্ছে, যেমনটা সবসময় দিতো। আমি মনোযোগ দিয়ে ওকে দেখছি। আটচল্লিশ বছরে কেমন বুড়িয়ে গেছে ও। জীবনের উপর দিয়ে টানা রোলারকোস্টার চলে গিয়েছে, চোখে-মুখে তার স্পষ্ট ছাপ। গত বছর অবশ্য ও বিয়ে করেছে, ওর এক ডিভোর্সি সহকর্মীকে।
ওর বিয়ে নিয়ে আমাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। আমার আপনজনরা তো বলেই বসেছে যে আমাকে সে নাকি মোটেও ভালোবাসতো না। তা না হলে আবার সে বিয়ে করতে পারে? আমার অবশ্য সেরকম কিছু মনে হয় না। আমি জানি সে আমাকে ভালোবাসতো, অনেক ভালোবাসতো। তবে পুরুষমানুষ নাকি এমনই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, একবার বিয়ে করার পর, “নরমাংসের স্বাদ পাইলে মানুষের সম্বন্ধে বাঘের যে দশা হয়, স্ত্রী সম্বন্ধে তাহার ভাবটা সেইরূপ হইয়া উঠে। অবস্থা যেমনি ও বয়স যতই হউক, স্ত্রীর অভাব ঘটিবামাত্র তাহা পূরণ করিয়া লইতে তাহার কোন দ্বিধা থাকে না।” তাই ওর বিয়ের ব্যাপারটা আমার কাছে আশ্চর্যের কিছু ছিল না।
কিন্তু এসব কথা আমি কাউকে বলি না। এসব শুনলে পুরুষরা বলবে আমি তাদের বদনাম করছি, আর নারীরা বলবে আমি পুরুষদের হয়ে সাফাই গাইছি।
ওর নতুন স্ত্রী দেখলাম ওর মতোই হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত। একেবারে সোনায় সোহাগা যাকে বলে। শুধু অল্পতেই অতিরিক্ত জোরে জোরে হাসে। আমার কাছে ব্যাপারটা দেখতে বেহায়ার মতো লাগে। কিন্তু আমার তাকে বেহায়া মনে হলেই কী আর না হলেই কী, আমার দুই ছেলে দেখলাম তার বিশেষ ভক্ত। যদিও আমাকে সেকথা তারা বলেনি, কিন্তু আমি ঠিকই বুঝতে পারি।
যাই হোক, আমি ঠিক করেছি জীবনে আর কিছু নিয়ে কখনো মন খারাপ করবো না। কেননা আমি যা চেয়েছি তা পেয়েছি—আমার ছেলেটা এখন সুস্থ। কিন্তু তারপরও বুকের মধ্যে কেন জানি একটা চিনচিনে ব্যথা করে।
আমরা চুপচাপ কফি খেয়ে যাচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। পরিবেশ হালকা করার জন্য আমি বলে উঠলাম,
—তুমি দেখি বুড়া হয়ে গেছো?
—বয়স হয়েছে না। তাছাড়া কাজের চাপে অবস্থা টাইট। কাজের স্ট্রেসে প্রতিদিন একবছর করে বয়স বাড়ছে। তোমার কী অবস্থা?
—ভালো।
—আমি বুড়া হয়েছি কিন্তু তোমার তো দেখি এখনো বয়স বাড়ে না।
আমি হাসলাম। আমাদের এত বছরের বিবাহিত জীবনে এই কথাটা আমি হাজারবার শুনেছি। আমাকে কমপ্লিমেন্ট করার জন্য এটা ছিল ওর প্রিয় বাক্য। আগে হয়তোবা ব্যাপারটা খুব একটা মিথ্যা ছিল না। কিন্তু গত পাঁচ বছরের জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত আমি এখন একজন নিষ্প্রভ প্রাণ। আমার বয়স চুয়াল্লিশ না চুরাশি, তা আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারি না।
এরপর আমরা ছেলেদের গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম। সময় কিভাবে পার হয়ে গেলো বুঝতে পারলাম না। কয়েক ঘণ্টা সময় যেন মনে হলো কয়েক মুহূর্ত। সে দেখলাম আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তিত। ছেলেরা তো এখন ইউনিভার্সিটিতে, একা একা আমার সময় কেমন করে কাটবে? আমি এইসব কথা পাত্তা দেইনি। আমি আমার কাজ আর ছেলেদের চিন্তা নিয়ে ভালোই আছি। আর বলেছি না, আমি কিছু নিয়ে আর মন খারাপ করবো না। কেননা আমি যা চেয়েছি তা পেয়েছি। আমার আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই।
রাতে দুই ছেলে আর তাদের বাবার সঙ্গে খুব সুন্দর সময় কেটে গেলো। সুন্দর কিছু স্থায়ী হয় না। সেই রাতে আমি আর ছোট ছেলে সেখানেই একটা হোটেলে থেকে পরের দিন ফিরে গেলাম যে যার আস্তানায়। ছেলেদের ছাড়া বাসাটা আজকাল খুব খালি খালি লাগে। তবে বাসা খালির চেয়ে বুকের ভেতরটা যেন বেশি খালি লাগে।
কিন্তু নিজেকে ব্যস্ত রাখি আমি, কেননা ঠিক করেছি যে কিছু নিয়ে মন খারাপ করবো না। তারপরও মাঝে মাঝে মনে হয় যে ডিভোর্সের আগে ও বলেছিলো তিন দিনের জন্য দুজনে মিলে একটু কোথাও বেরিয়ে আসার কথা, জীবনটাকে একসাথে একটু খতিয়ে দেখার কথা। যাওয়া হয়নি তখন আমার। যেতে চাইনি আমি। এখন আমার হাতে অফুরন্ত সময়। যখন-তখন কাজ থেকে ছুটি নিয়ে যেখানে-সেখানে বেড়িয়ে আসতে পারি।
কিন্তু আমার কোথাও তেমন যেতে ইচ্ছা করে না। শুধু ইচ্ছা করে সেই ছুটিতে যেতে, যেই ছুটির নিমন্ত্রণ আমি পেয়েছিলাম ওর কাছ থেকে। জীবনযুদ্ধ থেকে ছুটি নিয়ে জীবনটাকে খতিয়ে দেখার সেই ছুটি।
কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে, সেই ছুটি যে কখন ফুরিয়ে গেছে। যা ফুরিয়ে গেছে, তা তো আর কখনও ফিরে পাবার না।
©আমিনা তাবাস্সুম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top