পারুল ঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে আপন মনে ময়লা নখ খুঁটছে। কথাবার্তা যা তার খালাই বলে চলছে। সেই দিকে পারুলের কোনো মন নেই। ওর মন পড়ে আছে, কখন একটু খাওয়া পাবে সেই আশায়। খালা বলে এনেছে যে আজ থেকে আর কোনো খাওয়ার কষ্ট নেই। পারুলের নাকি বিশাল কপাল। তা না হলে এই বাড়িতে কাজ করার ভাগ্য হয় কারো? তাদের গ্রামের ফিরোজাবুও এই বাসায় কাজ করে। ফিরোজাবু যখন ছুটিতে দেশে যায়, পারুল তখন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। কী সুন্দর স্বাস্থ্য, কী ঝকঝকে চেহারা, পারুল চোখ ফেরাতে পারে না। পারুল কি এরকম হয়ে যাবে? বুকের মধ্যে অজানা ভয় আর আশার অনুভূতি নিয়ে জীবনে প্রথম গ্রাম ছেড়ে খালার হাত ধরে পারুলের এই ঢাকায় আসা।
ফিরোজাবুর সাথে ছোটোখাটো ফুটফরমাশ খাটার জন্য পারুলকে এই বাড়িতে আনা হয়েছে। বড় কোনো কাজ নেই। বাসায় রান্নার এক বুয়া আছে, কাপড় ধোয়া, ঘর ঝাড়ু দেওয়া-মোছা আর বেগম সাহেবের এক পঙ্গু মেয়ের দেখাশোনার জন্য ফিরোজাবু আছে। পারুলের কাজ শুধু সাহেব-বেগমসাহেবের ফুটফরমাশ খাটা আর ফিরোজাবুকে সাহায্য করা। এর বদলে গ্রামে তার মা আর ছোট দুই ভাইবোন খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতে পারবে। আর তার হবে ফিরোজাবুর মতো ঝকঝকে স্বাস্থ্য আর চেহারা। আসলেই, ভাগ্যই বটে। পারুলের অবশ্য তিনবেলা ভালো খাওয়ার লোভ ছাড়া আর তেমন কিছু মাথায়ই ঢুকেনি। ঢুকবেই বা কীভাবে? কতই বা বয়স হবে তার? আট কি নয়? কিন্তু সেই কখন থেকে খালা সেই বিশাল স্বাস্থ্যের বেগম সাহেবের সাথে বকবক করে যাচ্ছে, যে খাওয়া পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছে না পারুল। অবশেষে কথা শেষ হলো। খালা পারুলের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে চোখের পানি মুছতে মুছতে বিদায় নিল। পারুলের চোখে কোনো পানি নেই। সে শুধু বসে আছে কখন একটু খাবার পাবে সেই আশায়।
হঠাৎ তার চমক ভাঙল বেগম সাহেবের ডাকে;
“এই মেয়ে, এখন থেকে আমাদের খালা আর খালু ডাকবা, আর ঐটা হলো আপা।“
পারুল অকপটে হুইলচেয়ারে বসা রুনাকে দেখে নিল। রুনার বয়স ছাব্বিশ বছর। ওর দৃষ্টি পারুলের দিকে স্থির আর মুখ দিয়ে লালা পড়ছে, আর গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে।
হঠাৎ বেগম সাহেব ফিরোজাবুর দিকে তাকিয়ে রীতিমতো হুঙ্কার দিয়ে উঠল;
“অ্যাই মাগী, দাঁড়ায় দাঁড়ায় কী দেখছিস? দে রুনার মুখ মুছায়ে।“
পারুল দেখে যে ফিরোজাবু অলস ভঙ্গিতে তাচ্ছিল্যের সাথে মুখটা মুছিয়ে দেয়। পারুলের পেটটা খিদায় একেবারে মোচড় দিয়ে উঠে। বেগম সাহেব আবার হুঙ্কার দিলেন;
“যা ফিরোজা, সঙের মতো দাঁড়ায় না থেকে, এই বস্তির নোংরা নোটি মেয়েটাকে পরিষ্কারের ব্যবস্থা কর। আমার বাড়িতে এরকম নোটিপানা চলবে না।“
অবশেষে খাওয়া পেতে পেতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। প্লেট ভর্তি ভাত, একটু ডাল আর এক টুকরা মুরগি। এত খাবার পারুল কবে খেয়েছে তা ঠিক মনে করতে পারল না। মা আর ছোট ভাইবোন যদি একটু খেতে পেত? নিজের অজান্তেই পারুলের চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল।
শুরু হলো পারুলের নতুন জীবন। এখানে সব আছে, কিন্তু ওর কেন জানি কিছুই ভালো লাগে না। অকারণ কান্না পায়। কাজ তেমন কিছু না, কিন্তু খালা কখনো গালাগালি দেওয়া ছাড়া কোনো কথা বলতে পারে না। বেশিরভাগ গালিই পারুল বুঝতে পারে না, তবে বুঝতে পারে যে ভালো কিছু বলা হচ্ছে না। গালি অবশ্য পারুলের চেয়ে ফিরোজাবু অনেক বেশি খায়। ‘বেশ্যা’, ‘মাগী’, ‘ছিনাল’—এগুলোই যেন ফিরোজাবুর নাম। কিন্তু ফিরোজাবুর যেন কিছু যায় আসে না। মুখে আঁচল দিয়ে খালি হাসে। এই কারণেই ফিরোজাবুকেও পারুলের ভালো লাগে না।
তাছাড়া, খালা বাসায় না থাকলে ফিরোজাবু রুনা আপারও অনেক অযত্ন করে। টিভি দেখার নেশায় রুনা আপার পেশাব-পায়খানা পরিষ্কার করে না, চোখ-মুখ লালা-পানিতে একাকার হয়ে থাকে, তাও পরিষ্কার করে না। খাইয়ে দেয় কোনোরকমে ঠেসে ঠুসে। রুনা আপা অসহায় ভঙ্গিতে পারুলের দিকে চেয়ে থাকে। শুধু গোঁ গোঁ শব্দটা আরো বেড়ে যায়। পারুলের ভালো লাগে না। ফিরোজাবুকে কিছু বললে সে বলে;
“তোর যখন এত পীড়িত, তাহলে তুই সব করে দে না।“
পারুল আর কথা বাড়ায় না।
তবে এই বাড়ির সাহেব খালুকে পারুলের অনেক পছন্দ। সে কাজ থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ঘরে ফিরে ঠিকই পারুলের দিকে খেয়াল করে। বলে;
“কী পারুল বেগম? খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হয়েছে?”
পারুল মাথা নেড়ে শুধু বলে, “জি”। কখনো জানতে চায়, “মায়ের জন্য মন কেমন করে?” কখনো বলে, “পড়াশোনা করতে মন চায় পারুল বেগম?” পারুল সবকিছুতে মাথা নেড়ে সায় দেয়। মাঝে মাঝে বলে, “পারুল বেগম, আজকে আমার মাথায় অনেক যন্ত্রণা। মাথাটা কি একটু টিপে দেওয়া যাবে?” পারুল মাথা নেড়ে রাজি হয়। মাথা টিপে দেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে ছোটখাটো পুরস্কারও পায় পারুল—কখনো চকলেট, কখনো কলম, কখনো স্নো ক্রিম। পারুল সেগুলো সব সযত্নে তুলে রাখে। দেশে গেলে ভাইবোনের জন্য নিয়ে যাবে। ফিরোজাবু এসব দেখে মুখে আঁচল দিয়ে হাসে। বলে;
“আহা, কত পীড়িত!”
পারুলের রাগে গা জ্বলে যায়। কিন্তু সে আর কথা বাড়ায় না।
মাঝে মাঝে শুধু মাথা টিপে দেওয়া নয়, ঘাড়, হাত, পা—সবই টিপে দেয় পারুল। ওর বাবা যখন বেঁচে ছিল, ঠিক এভাবেই পারুলকে টিপে দিতে বলত। খালু বলে;
“পারুল বেগম, তোর হাতে দেখি জাদু আছে।“
বাবাও বলত;
“পারুরে, তোর হাতে তো শুধু মধু আর মধু।“
এই খালুর সাথে কাটানো সময়টা পারুলের একটু ভালো লাগে। একমাত্র এই খালুই তার সাথে ভালো-মন্দ দুই ধরনের কথা বলে। ফিরোজাবুর এটা একদমই পছন্দ না। নানান ছলে বলে আর কাজের অজুহাতে পারুলকে খালুর কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। পারুলের মেজাজ খারাপ হয়। ফিরোজাবু বুঝতে পেরে মুখে আঁচল দিয়ে হাসে।
এরপর পারুলের জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু হলো। খালুর সাথে কাটানো সময়গুলো অন্যদিকে মোড় নিতে থাকল। শুধু হাত-পা আর মাথা টিপে দেওয়ার মধ্যে সবকিছু সীমাবদ্ধ থাকল না। পারুলকে আরো অনেক কিছু টিপে দিতে, ছুঁয়ে দিতে হতো। এই সুযোগে খালু তার শরীর নানাভাবে ইচ্ছামতো ছুঁয়ে নিত। তার প্রিয় খালুরূপী সেই পিশাচের এই আচরণে পারুলের গা রিরি করে উঠত। মনে হতো, চিৎকার করে কোথাও পালিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় যাবে সে? তার দয়াতেই তো তার মা আর ভাইবোন বেঁচে আছে। প্রতিদিন খালুর সাথে কাটানো এই ‘প্রিয় সময়’টাই এখন পারুলের বিষের মতো মনে হয়। এই কথা তো কাউকে বলাও যায় না। সে ছোট হলে কী হবে, তার মনে হয়, সে নিজেই যেচে এই সুযোগ করে দিয়েছে। পারুল চোখ বন্ধ করে শুধু দোয়া করে, যেন এই সময়টা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু অভাগার দোয়া কি আর কাজে দেয়? পারুলের মনে হয়, এ যেন অনন্তকাল।
ফিরোজাবু সব বুঝতে পারে। বুঝবে না কেন? সে তো এই বাড়িতেই বড় হয়েছে। মাঝে মাঝে পারুলকে খুশি করার জন্য টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখতে ডাকে। পারুল যায় না। ওর কিছুই ভালো লাগে না। ফিরোজাবু বলে;
“গরিবের আবার এত ঢঙ?”
পারুল কিছু বলে না। ফিরোজাবু মুখে আঁচল দিয়ে হাসে।
পারুল সুযোগ পেলেই রুনা আপার হুইলচেয়ার ঘেঁষে বসে থাকে। রুনা আপা তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আর মুখ দিয়ে একধরনের গোঁ গোঁ শব্দ করে। এই নির্বাক বিকলাঙ্গ মেয়েটার জন্য যেন পারুলের অদ্ভুত এক মায়া। তারা দুজনই কোনো এক দিক থেকে যেন এক এবং অভিন্ন। নিয়তি কোনো বিচিত্র কারণে তাদের সীমাহীন কষ্ট দিয়েছে, কষ্ট উপলব্ধি করার প্রবল ক্ষমতা দিয়েছে, কিন্তু কষ্ট প্রকাশের পথ যেন চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। মনের ভেতর ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠা ছাড়া আর কিছু করার ক্ষমতা তাদের নেই।
© আমিনা তাবাস্সুম