Ameena Tabassum

সাহারা মরুর পারে

“মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায়, বিহবল চঞ্চল পায়, বিহবল চঞ্চল পায়।”

ছোটবেলায় টেলিভিশনে বা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রায়ই পুতুল টাইপের কোনো ছোট মেয়েকে এই গানের সাথে নাচতে দেখতাম। এত ভালো লাগতো যে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। মনেহয় দেখতে দেখতে সেই পুতুল টাইপের মেয়ের জায়গায় আমি নিজেকে কল্পনা করে নিতাম। সঙ্গত কারণে নিজের চেহারা সম্পর্কে আমার তেমন উচ্চমার্গীয় ধারণা ছিলোনা – আমি মোটেও পুতুল টাইপের ছিলাম না। আর নাচ তো জানতামই না। তাই কল্পনাই ভরসা। কল্পনা করেই আমি খুশি ছিলাম। তবে কল্পনার ক্ষমতা অসীম। কল্পনায় প্রভাব ফেলা ব্যাপারগুলো আমাদের মস্তিষ্ক নিজের অজান্তেই সযত্নে রেখে দেয়। সময়মতো আবার বের করে এনে নিজেকেই চমকে দেয়। এই “মোমের পুতুল” গানটাও ঠিক তেমনি একটা ব্যাপার।

এত কথা বলার কারণ হলো, বেশ কিছুদিন আগে মরোক্কতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে সাহারা মরুভূমি দেখার সুযোগ হয়েছিলো। নতুন কোথাও বেড়াতে গেলে আমি সাধারত জায়গাটা সম্পর্কে অল্প-বিস্তর জেনে যাবার চেষ্টা করি। এবারো সেই চেষ্টাই করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম যাই জানার চেষ্টা করি না কেন, কিছুই আমাকে টানছেনা। কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। শুধুমাত্র সাহারা মরুভূমি স্বচক্ষে দেখতে পাবো সেই আনন্দে আমার মাথার ভিতরটা একটা গানের তালে তালে দুলে উঠছে।

“মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায়, বিহবল চঞ্চল পায়।”

আমরা মরুভূমির যেই অংশে গিয়েছিলাম, সেই জায়গাটার নাম জাগোরা (Zagora Desert)। দক্ষিণ-পূর্ব মরক্কোর ড্রা উপত্যকার (Draa Valley) ধারে আর অ্যান্টি-অ্যাটলাস (Anti-Atlas) পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত এই জাগোরা, সাহারা মরুভূমির দরজা (gate of the Sahara desert) হিসাবে সুপরিচিত। ড্রা উপত্যকাকে আবার মরোক্কের খেজুরের ঝুড়ি (date basket) বলা হয়। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম খেজুর গাছের এলাকা (date palm grove area) এবং এখানে নাকি ষোলো প্রকারের খেজুরের চাষ করা হয়।

গ্রীষ্মের এক তপ্ত সকালে মরোক্কোর মারাকেশ শহর থেকে পরিবারের চারজন মিলে একটা বড়োসড়ো গাড়িতে চেপে জাগোরা মরুভূমির উদ্দেশ্যে রওনা করেছিলাম। সাথে ছিল জাকারিয়া নামের এক ছেলে, যে আমাদের ট্যুর গাইড প্লাস ড্রাইভার। মারাকেশ থেকে জাগোরা প্রায় ছয়-সাত ঘন্টার যাত্রা (কয়েকবার যাত্রা বিরতি নিয়ে অবশ্য)। আমাদের তাড়াহুড়ো ছিলোনা। এই ভর গ্রীষ্ম মরুভূমি সফরের জন্য একেবারেই আদর্শ সময় না। তাই আমরা অনেক সকাল সকাল রওনা করলেও সূর্যাস্তের আগে মরুভূমিতে যাবার কোনো ইচ্ছা ছিলোনা। সারাটাদিন খরতাপ হলেও সন্ধ্যা নামলেই মরুভূমির তাপমাত্রা নাকি কমতে থাকে। তাই রাতের বেলা মরুভূমিতে গেলে নাকি অসহনীয় গরম তো থাকেই না, বরং সুন্দর একটা আবহাওয়া পাওয়া যায়। তাই আমরা পথিমধ্যে বেশ কয়েকটা দর্শনীয় স্থান, খেজুরের বাগান এসব সফর করে বিকেলের দিকে ঠিক মরুভূমির কাছের একটা হোটেলে পৌঁছে যাই। সেসময় একেবারে অসহনীয় তাপমাত্রা। কেমন করে এই তাপমাত্রা সহনীয় হবে কি না তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

তারপরও আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে একটু ফ্রেশ হয়ে আর রেস্ট নিয়ে ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে আগে সাহারা মরুভূমি দেখার জন্য হোটেল থেকে বেরিয়ে এলাম। আমাদের পরিকল্পনা হলো উটের পিঠে চড়ে আমরা মরুভূমির মাঝে গিয়ে সূর্যাস্তের সৌন্দর্য উপভোগ করবো। সেই অনুসারে আমাদের জন্য আগে থেকেই পাঁচটা উট ঠিক করা ছিলো। আমাদের পরিবারের জন্য চারটা, আর জাকারিয়ার জন্য একটা। আর আমাদের সাথে যাবে মরোক্কের আমাজিগ উপজাতির এক উট চালক।

জীবনে মনেহয় এই প্রথম এত কাছে থেকে উট দেখার সুযোগ হলো। উট দেখে তো আমি মুগ্ধ। তবে উটগুলোর চেহারা এত মায়া আর করুণ যে ওদের দেখে বুকটা কেমন মুচড়ে উঠলো। উটের জন্য আমার থেকে আমার হাজবেন্ডের অবশ্য বেশি মায়া হলো। সে উটগুলো দেখে জানিয়ে দিলো সে উটের পিঠে চড়ে উটকে কষ্ট দিতে চায়না। তবে উটের পিঠে চড়তে তার ভয় লেগেছিলো কিনা সেই ব্যাপারটা এখনো জানা হয়নি।

আমি ভাবলাম, এ তো মহা যন্ত্রনা হলো। পাঁচ পাঁচটা উট দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্য। এখন আমার জামাই বাগড়া দিলে কেমন লাগে?

অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো, আমি, আমার ছেলে আর মেয়ে মিলে সেই উট চালকের সাথে উটের পিঠে চড়ে মরুভূমি দেখবো। আর আমার হাজবেন্ড আর জাকারিয়া গাড়িতে করে অন্য একটা রাস্তা দিয়ে (যে পথে গাড়ি চালানো যায়) মরুভূমি দেখবে। তবে মরুভূমির মাঝে একজায়গায় গিয়ে আমরা সবাই একসাথে হবো। সেখানে সবাই সূর্যাস্ত আর সন্ধ্যাতারা অবলোকন করবো।

অস্তমিত সূর্য, সোনালী বালিয়াড়ি, দীর্ঘ যাত্রা, আমাদের নিশ্চুপ উটচালক, বালিয়াড়ির উপরে ওঠা-নামার দরুন উটের দুলুনি, সন্ধ্যা নামার মুখের মৃদু ‘লু’ হাওয়া, রুক্ষ খেজুর গাছ সব মিলিয়ে উটে চড়ার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে নজরুলের সেই গান …..
খর্জুর-বীথির ধারে
সাহারা মরুর পারে
বাজায় ঘুমুর ঝুমুর ঝুমুর মধুর ঝঙ্কারে।
উড়িয়ে ওড়না ‘লু’ হাওয়ায়
পরী-নটিনী নেচে যায়
দুলে দুলে দূরে সুদূর।।

এতক্ষনে বুঝতে পারলাম কেন আমার মস্তিষ্ক বারে বারে এই গানটা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো।

জাগোরাতে বেশ কয়েক জাতির মানুষের বসবাস। এরমধ্যে আমাজিগ উপজাতি (Amazigh tribes) আর আফ্রিকান (black African যারা সাব-সাহারান আফ্রিকা থেকে দেশান্তরিত হয়েছিল) তারাই প্রধান। এছাড়া বেশ কিছু আরবদেরও বসবাস এখানে। আমাজিগ উপজাতিদের বানানো তাঁবুতে আমরা সারারাত মরুভূমিতে কাটাতে পারতাম। কিন্তু গরমের কথা চিন্তা করে আমরা সেটা করিনি। তবে গ্রীষ্মকাল না হলে অবশ্যই সেই তাঁবুতে রাত কাটাতাম।

জাগোরার ইতিহাস, জীবনযাত্রা বা মানুষদের সম্পর্কে খুব একটা জানার সুযোগ হয়নি। কিন্তু এই উটের পিঠের মরুভূমির যাত্রা এবার আমাকে ছোটবেলায় নজরুলের কবিতায় পড়া ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর-ফারুকের কথা মনে করিয়ে দিলো,
প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি
চলিছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্টের রশি ধরি!
মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,
সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে।
পুরোটা পথ উটের পিঠে বসে আমার মাথায় ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজতেই থাকলো ……
“ভৃত্য চড়িল উটের পিঠে উমর ধরিল রশি,
মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী”
উটের যাত্রা শেষে আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেখি আমার হাজবেন্ড আর জাকারিয়া আগেই পৌঁছে গিয়েছে। সেখানে আমরা কিছুক্ষণ বিরতি নিলাম, সোনালী বালুকাবেলায় হাঁটাহাঁটি করলাম, ছবি তুললাম, বালিয়াড়ির উপরে উঠতে গিয়ে কয়েকবার পিছলে পড়লাম, সূর্যাস্ত দেখলাম, ঝিকিমিকি সোনালী মাটির উপর দাঁড়িয়ে আকাশের রূপালি তারাও দেখলাম। আর আশ্চর্যের সাথে উপলব্ধি করলাম, সন্ধ্যা নামতেই কী মিষ্টি শীতল আবহাওয়া নেমে এলো। নাহ, পৃথিবীটা বড়ই সুন্দর, বড়ই রহস্যময়, বড়ই অদ্ভুত।
এরপর আমাদের ফেরার পালা। আমরা তিনজন পাঁচটা উট নিয়ে রাতের রুপোলি আলোয় রওনা করলাম। আর আমার হাজবেন্ড আর ট্যুর গাইড যথারীতি গাড়ি নিয়ে অন্যপথে রওনা করলো। ফেরার পথে তাদের গাড়ির চাকা বিশাল বালিয়াড়িতে ডুবে গিয়ে তারা দীর্ঘ সময় জনমানবহীন, মোবাইলের নেটওয়ার্ক বিহীন, শুনশান মরুভূমিতে আটকে ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা কেমন করে উদ্ধার পেলো, সে আরেক নতুন গল্প।
তবে আমরা বাকি তিনজন সহিসালামতে সময়মতো উটে চড়ে হোটেলে ফিরে আসি। যাবার সময় গিয়েছিলাম অস্তমিত সূর্যের সোনালী আলো গায়ে মেখে, ফিরে এসেছি রহস্যময় জ্যোৎস্নার রূপালি আলোয় স্নান করে আর গুনগুন করে গাইতে গাইতে …
সুর্মা-পরা আঁখি হানে আসমানে,
জ্যোৎস্না আসে নীল আকাশে তার টানে।
ঢেউ তুলে নীল দরিয়ায়
দিল-দরদী নেচে যায়
দুলে দুলে দূরে সুদূর।

© আমিনা তাবাস্সুম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top