Ameena Tabassum

সৌন্দর্য

সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। যতই মুখে বলিনা কেন,”বিউটি লাইস ইন দ্য আইস অফ দ্য বিহোল্ডার”, এই জগতে মনে হয় সামান্য কিছু চোখ আছে, যেখানে অসুন্দরকেও সুন্দর মনে হয়। অনেক অল্প বয়সেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে আমি অসুন্দর। কালো গায়ের রং, হাড্ডিসার স্বাস্থ্য, তুলনামূলক খাটো আর উঁচা দাঁতের কারণে ছোটবেলা থেকেই আমার হীনমন্যতার কোনো শেষ ছিলোনা। মনে আছে তখন আমি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। ক্লাসে বসে একদিন সব কয়টি মেয়েকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে মনে হয়েছিল আমি সবার থেকে অসুন্দর। এই কথা তো আর কাউকে বলা যায়না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর এই পক্ষপাতদুষ্টতা নিয়ে অনেক অনেক নালিশ করেছিলাম। নালিশ অবশ্য তেমন কোনো কাজে দেয়নি। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির রহস্য যে কী তা তিঁনিই জানেন। সেটা তুচ্ছ অসহায় ক্লাস থ্রিতে পড়া এক বালিকার পক্ষে বুঝা সম্ভব না।

তবে সৃষ্টিকর্তার নিকট কোনো আবেদন নাকি বৃথা যায়না। সময়ের সাথে সাথে তিনি আমার সৌন্দর্যের কোনো হেরফের না করলেও, আমার মানসিকতা বদলে দিয়েছেন। আমার যা অসুন্দর তা মেনে নেওয়ার মনোভাব তৈরি করে দিয়েছেন। অগত্যা মেনে নেওয়া না, খুশি হয়েই মেনে নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন। তবে এই পর্যন্ত যাত্রা যে খুব একটা সহজ ছিল তা না। জীবনের অনেক চড়াই উৎরাই পার করে তবেই না সেই ক্লাস থ্রির আমি, আজকের এই আমিতে রূপান্তরিত হয়েছি।

ছোটবেলা থেকে নাটকের প্রতি আমার খুবই ঝোঁক। আমার মা আমার এত শখ দেখে আমাকে শহরের এক নামকরা নাট্য সংগঠনে ভর্তি করে দেন। সেখানে অভিনয় শেখা ছাড়াও, সেই সংগঠনের আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণের ছিল অবাধ সুযোগ। সেখানে ভর্তি হতে পেরে আমি যে কত আনন্দিত হয়েছিলাম, তা এখনো চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলে সেই উত্তেজনার হৃদস্পন্দন অনুভব করতে পারি। কোনো কিছুর প্রতি দুর্বার আকর্ষণ থাকলে তা নাকি অর্জন করা সম্ভব। অল্প কিছুদিনেই বুঝে গেলাম আমি মারাত্মক ভালো অভিনয় করতে পারি। আমার গুরুরাও আমার অভিনয়ে চমৎকৃত। আমাদের গ্ৰুপের সবাই আমাকে আমার এই প্রতিভার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসে। সেই গ্ৰুপে আরো কয়েকজন অনেক ভালো অভিনয় করলেও, এটা পরিষ্কার যে আমার ধারে কাছেও কেউ নেই। কিছুদিন পর আমাদের গ্ৰুপের নাটক পরিবেশনা হবে। নাটকটি হলো শরৎচন্দ্রের “পরিণীতা”। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে আমি নাটকের নায়িকা ললিতার চরিত্রটি পাবো। আমার অভিনয় প্রতিভা নিয়ে আমি এতই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে কিছুদিনের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম যে নাটকের নায়িকা হতে হলে অভিনয়ের পাশাপাশি নায়িকার মতো চেহারাটারও যে বড়ই দরকার। শত শত দর্শক নাটক দেখতে এসে নায়িকার চেহারা দেখেই হতাশ হয়ে গেলে কী করে হবে? তাই আমি পেলাম নায়ক শেখরের মা ভুবনেশ্বরীর পার্ট। এরপর আরো কিছুদিন সেই সংগঠনে ছিলাম। কখনও মূল কোনো চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ হয়নি। অবশেষে আমার গুরুর মনে হয় আমার জন্য করুনা হলো। শুধুমাত্র আমার কারণেই মনে হয় শরৎচন্দ্রের অরক্ষণীয়া নাটকটি মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। আর আমি মূল চরিত্র জ্ঞানদার পার্টটি পেলাম। রোগে শোকে পর্যুদস্ত জ্ঞানদা নাটকের বেশিরভাগ অংশেই দেখতে এক অসুন্দর নারী চরিত্র। নাটকটিতে আমার অভিনয় সারা শহরে ব্যাপক সাড়া জাগালেও আমি এর পর নাটক করা ছেড়ে দেই। প্রতিভার চেয়ে চেহারা যখন নাটকের বড় অংশ, আমি বুঝে নিলাম সেই নাটকে আমার কোনো স্থান নেই।

এরপর আমি পড়াশুনায় মন দিলাম। পরীক্ষার খাতায় তো আর কেউ চেহারা দেখে নম্বর দিবেনা? পড়াশুনার মধ্যেই যেন নিজের মুক্তি খুঁজে পেলাম। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থিনীতিতে অনার্স আর মাস্টার্স দুটোতেই প্রথম হয়ে সেখানেই অধ্যাপনার সুযোগ পেয়ে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই আরেকজন মেধাবী সহপাঠীর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়ে উঠে। কখনও কেউ কাউকে সরাসরি প্রেম নিবেদন না করলেও আমাদের এই পাঁচ ছয় বছরের সময়টি কেটেছে একসাথে, নিজেদের সুখ দুঃখ বন্টন করে, নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব করে। আমার মনে হতো সে শুধু আমার প্রিয় বন্ধুই না, আরও যেন অনেক কিছু। শুধু আমার নিজের মধ্যকার হীনমন্যতার কারণে কখনও কিছু বলে উঠা তো দূরের কথা, আভাসে, ইঙ্গিতেও আমার ইচ্ছাটা প্রকাশ করার চেষ্টা করিনি।

তবে চেহারা নিয়ে হীনমন্যতা সেসময় কিছুটা হলেও কমে এসেছিলো। আমার মনে হয়েছিল, এই আধুনিক যুগে, সুন্দরভাবে সেজে নিজেকে উপস্থাপন করলে বাহ্যিক সৌন্দর্যের কমতিটা কিছুটা হলেও পূরণ করা যায়। কিছুদিন অধ্যাপনা করার পরই আমি যুক্তরাষ্ট্রের এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডির জন্য ভালো স্কলারশিপ পেয়ে যাই। এই খবরে আমি যতটা আনন্দিত হই তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট পাই আমার সেই প্রিয় বন্ধুকে ছেড়ে যাবার আশংকায়। শেষ পর্যন্ত সেই মুখ খুললো। আমার এতদিনের পুঞ্জীভূত আশাটাকে সত্যি করে সে আমাকে প্রেম নিবেদন করে বসলো। সেই নাটকের সংগঠনে ভর্তি হবার পর আমার আর কী হৃদস্পন্দন হয়েছিল, তার এই ভালোবাসার আবেদনে আমার হৃদপিন্ড আনন্দে এত জোরে ধড়ফড় করছিলো যে মনে হচ্ছিলো সেই মুহূর্তে হার্ট ফেল করে মরেই যাবো। তারপর দুই পরিবারের সম্মতিক্রমে দ্রুত বিয়ের কাজটা শেষ করে আমরা দুজনেই যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি। আমার বরও মেধাবী, সে প্ল্যান মোতাবেক আমার ইউনিভার্সিটিতেই নিজের ফান্ডিংএ মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে যায়।

ভালোই চলে যাচ্ছিলো আমাদের জীবন কিন্তু আচমকা কোথা থেকে যেন কী হয়ে গেলো। আমাদের শহরেই আমার খুবই আদরের এক ছোট খালাতো বোন তার স্বামী নিয়ে থাকতো। সদা লাস্যময়ী, মায়াবী চেহারার অসাধারণ গুণী আর মিশুক আমার এই বোনটার অল্প বয়সেই এক রেস্টুরেন্ট ব্যাবসায়ী স্বচ্ছল প্রবাসী বাংলাদেশির সাথে বিয়ে হয়ে যায়। এখানে এসে আমার সেই বোনটাকে যেন চিনতেই পারিনি। বুঝতে পারি তার স্বামী মদ্যপ। শারীরিক আর মানসিক ভাবে আমার বোনটার উপর বিভিন্ন অত্যাচার করে। আমি আর আমার বর দুজনে মিলে, আমার বোনটাকে একটা কলেজে লুকিয়ে লুকিয়ে পার্ট টাইম পড়াশুনায় ভর্তি করে দেই, ধীরে ধীরে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বিভিন্ন উপায় করে দেবার চেষ্টা করি, যাতে করে এই পিশাচের সংসারে তাকে আজীবন পচে মরতে হয়না। পিশাচের সংসার ভাঙতে গিয়ে বুঝতেই পারিনি কখন আমার সাজানো সংসার ভেঙে চুরচুর হয়ে যায়। যখন বুঝতে পারি তখন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে।
আমি কাউকে দোষারোপ করিনা। আমার সেই বোনটি বড়ই মিষ্টি। আমি নিজেই সারাজীবন তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে এসেছি। আমার বরের মুগ্ধ না হবার কোনো কারণ নেই। আর বোনটি গত দেড়বছর তার অত্যাচারী স্বামী দ্বারা এতই নিপীড়িত ছিল যে তার বোনের ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলে। আমি সব মেনে নিয়েই নিজের আত্মসম্মান বজায় রেখে সরে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একদিন যখন এসব নিয়ে ঠান্ডা কথা কাটাকাটির সময় আমার বর আমাকে বলে উঠলো যে তোমার তো দেখি ভারী অহংকার। মনে হচ্ছে তুমি ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে দয়া করছো। আয়নায় নিজের চেহারাটা একবার ভালো করে দেখো। দয়া তো করেছি আমি তোমাকে। এতদিন তোমার সাথে সংসার করে। আমি হতভম্ব। এত বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা আত্মবিশ্বাস যেন এক চাবুকের আঘাতে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেলো।

শুরু হলো আমার নতুন জীবন। আবার নতুন করে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার যুদ্ধ। অনেকেই হয়তো বলবে যে এত শক্ত, সামর্থ্য, আত্মবিশ্বাসী একটা মেয়ে একটা কথার আঘাতে এত ভেঙে পড়লো? এটা আবার কেমন কথা? এটা কেমন কথা সেটা যার হয় সেই বুঝে। আমি বুঝলাম, ভেঙে পড়লাম কিন্তু নতুন করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। এদেশে মেয়েদের অনেক ছোট খাটো গ্ৰুপ বা সাপোর্ট নেটওয়ার্ক আছে, যেখানে নিজেরা কাউন্সিলিং করে নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার কাজ করে। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে একাকিত্ব দূর করার জন্য এধরণের এক দুইটা গ্ৰুপে যোগ দিলাম। এসব গ্ৰুপ সেশনে প্রায়ই আলোচনা হয় যে, “ইউ আর অল বিউটিফুল, ডোন্ট লেট্ এনিওয়ান টেল ইউ আদারওয়াইস”।

শুনে আমার ভালোলাগে। তবে নিজেকে আয়নায় মাঝে মাঝে দেখি আর ভাবি। না আমি দেখতে “বিউটিফুল” না। কিন্তু এতে কিছু আসে যায়না আর এতে আমার কোনো হাতও নাই। তবে আমি কেমন একজন মানুষ হবো, আমার ব্যবহার কেমন হবে, আমি আমার চরিত্রের খারাপ দিকগুলো কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো, আমি মানুষের জন্য কী করবো, এসকল সব বিষয়ে আমার সত্যিকারের হাত আছে। আর চরিত্রটাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমি অন্তরের দিক থেকে একজন সুন্দর মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারি। তবেই না আমি হবো আসল অর্থে বিউটিফুল।

এই উপলব্ধির পর থেকে আর কখনও আমার বাহ্যিক সৌন্দর্যের কথা মাথায় আসেনি। ঐযে ক্লাস থ্রিতে থাকাকালীন সৃষ্টিকর্তার কাছে নালিশের ফলস্বরূপই হবে হয়তো। সবসময় চেষ্টা করেছি নিজের খারাপটা বুঝে সংশোধন করার আর অন্যের ভালোটা দেখে তা থেকে শেখার। কতখানি সার্থক হয়েছি জানিনা, কিন্তু হীন্যমন্যতাহীন জীবনটা এখন অনেক সুন্দর মনে হয়। দশ বছর আগে আমি আবার বিয়ে করি। একজন সুন্দর মানুষকে যে আমাকে বলে আমি কত সুন্দর আর অসাধারণ একজন মানুষ। আর আমার জীবনটাকে আলো করে আছে আমার ফুটফুটে একটা মেয়ে। আজ আমার একমাত্র কামনা, তার জীবনটা সুন্দরে সুন্দরে ভোরে উঠুক। বাহ্যিক সৌন্দর্যে না, সত্যিকারের সৌন্দর্যে।

© আমিনা তাবাস্সুম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top