পরিচিত বাংলাদেশী মহলে আমার দুই ছেলের ভীষণ বদনাম। তাদের অপরাধ যে তাদের মা বৃদ্ধাশ্রমে থাকে। হ্যাঁ, বৃদ্ধাশ্রমই বলা যায়। তবে বৃদ্ধাশ্রমের তো প্রকারভেদ আছে। আমি যেখানে থাকি আমাদের এই যুক্তরাজ্যে তাকে বলা হয় রিটায়ারমেন্ট হোম। একটা কম্পাউন্ডের মধ্যে ছোট বড় হাতে গোণা কয়েকটা অ্যাপার্টমেন্ট, একটা বিশাল কমিউনাল মিটিং রুম, সুন্দর একটা খোলামেলা বাগান, সবমিলিয়ে ব্যবস্থা খারাপ না। এই রিটায়ারমেন্ট হোম একটা প্রাইভেট কোম্পানির, সবকিছুর ব্যবস্থাপনা আর পরিচালনার দায়িত্ব তাদের। রেসিডেন্টদের দেখভাল করার দায়িত্বও তাদের। বাড়ি ঘর তদারকির চিন্তা করতে হয়না, হঠাৎ শরীর খারাপ করে গেলে ভয়ের কিছু নেই আর সবচেয়ে বড় কথা এখানে একাকিত্বের যন্ত্রনা নেই।
আমার অ্যাপার্টমেন্টটা খারাপ না। দুই বেডরুমের ছিমছাম একটা ফ্ল্যাট, সাথে একফালি রান্নাঘর আর ছোট্ট একটা বসার ঘর। আর রুমের সাথে আছে অ্যাটাচড বাথরুম। নিজের বড় খোলামেলা বাসা ছেড়ে এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে নিজেকে মানিয়ে নিতে প্রথমে একটু কষ্ট হলেও এখানেই এখন ভালো লাগছে। আসলে এই বয়সে এসে একাকিত্বের কষ্ট হলো সবচেয়ে বড় কষ্ট। সেই কষ্ট থেকে আমি এখন মুক্ত।
তবে আমার নিজেকে মুক্ত মনে হলে কী হবে, আমার শুভাকাঙ্খীদের আপাতত ঘুম হারাম। সবার একটাই কথা। সারাটাজীবন ধরে এত কষ্ট করে, রক্ত পানি করে, ছেলেদের মানুষ করে কী লাভ হলো? বুড়া বয়সে এখন বৃদ্ধাশ্রমে পচে মরতে হচ্ছে। সবার ভাষ্যমতে এখন না হয় কোনোরকমে আলাদা অ্যাপার্টমেন্টে থাকার ব্যবস্থা করেছি, আরেকটু বয়স হলে তখন বৃদ্ধাশ্রমে শুধু একটা বিছানা নিয়ে দিন রাত পড়ে থাকতে হবে। মায়ের বাংলাদেশী বন্ধু-বান্ধবের কথায় আমার ইংল্যান্ডে বড় হওয়া দুই ছেলের কতটুকু যায় আসে আমি বলতে পারবোনা। তারা হয়তো জানেওনা যে তাদের এত বদনাম। আমি কখনও তাদের বলিনি। কিন্তু আমার মনেহয় তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে। মানুষজনের কথায় আমারও অবশ্য এমনিতে কিছু যায় আসেনা। কিন্তু আমার দুই ছেলে আমার দুই চোখের মনি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। আমার কাছে তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান। পৃথিবীর সব মানুষের সব কথা আমি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারি কিন্তু আমার দুই সন্তানের নামে কোনো অপবাদ আমার সহ্য হয়না। বুকের ভিতর হাসফাস লাগে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সবাই বুঝে যে আমি এসব কথা পছন্দ করিনা কিন্তু তারপরও ইনিয়ে বিনিয়ে কথাগুলো আমার কাছে তাদের তুলতেই হবে। নিজের নাম দিয়ে না হোক, অন্যের নাম দিয়ে হলেও বলতে হবে। সেইদিন যেমন মিতু ভাবি ফোন করে বললো,
– আল্লাহ জানো ভাবি, সেইদিন নাতাশাদের দাওয়াতে সবাই তোমাকে নিয়ে এত মন খারাপ করেছে যে বলার না।
– কেন আমি আবার কী করলাম?
– তুমি কিছু করোনি। কিন্তু দুই ছেলে থাকতে ওল্ড হোমে পড়ে থাকতে হচ্ছে। কী কষ্ট তোমার।
– পড়ে থাকতে হবে কেন? আমি তো নিজেই এখানে শখ করে থাকছি। আমি চাইলেই তো ছেলেদের সাথে থাকতে পারতাম। ছেলেরা অনেক খুশি হতো। আমি চাইনি, আমার নিজের মতো করে থাকতে ভালো লাগে।
– ভাবি, তুমি না আসলে খুবই ভালো একটা মা। সবসময় ছেলেদের প্রটেক্ট কর।
এই কথা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমি বন্ধুমহলে নরম মানুষ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এখন বয়স হয়েছে, প্যাঁচের কথাবার্তা আর সহ্য হয়না। কাউকে কথা শুনাতে পারিনা দেখে মেজাজ খারাপ করে ফোনই রেখে দিয়েছি।
নাহ, কিছুক্ষন পর বড় ছেলে, ছেলের বউ, নাতি নাতনি সবাই দেখা করতে আসার কথা। এইসময় আজাইরা মানুষজনের কথা চিন্তা করে মন খারাপ করার কোনো মানে হয়না। প্রায় উইকেন্ডেই ছেলেরা পরিবার নিয়ে আমাকে দেখে যায়, কিছুটা সময় আমার সাথে কাটিয়ে যায়। কখনও দুই ভাই আলাদা আসে, কখনওবা দুই ভাইয়ের পরিবারের সবাই একসাথে আসে। আমরা একসাথে একবেলা খাওয়া দাওয়া করি বা কোথাও বেরিয়ে আসি। আমার রান্না করতে কষ্ট হবে মনে করে ছেলে আর বউরা নিজেরা রান্না করে নিয়ে আসতে চায়। আমার এতে ঘোর আপত্তি। তাদের বাড়িতে গেলে যত ইচ্ছা আমাকে রান্না করে খাওয়াক। আমি তো মানা করিনা। আমার কাছে বেড়াতে এলে তাদের আমার রান্না খেতে হবে। আমি তো এত বুড়ি হইনি যে আমার ছেলেদের পরিবারের জন্য রান্না করতে পারবোনা। আমার বড় ছেলের আমার হাতের নেহারি খুবই প্রিয়। আজকে আমি তার জন্য নেহারি রান্না করেছি আর সাথে হাতে বানানো নান। আর বউ নাতি নাতনির জন্য হালকা মশলার মোরগ পোলাউ আর মাছের চপ। নাতি নাতনিরা হয়েছে তাদের মায়ের মতো। বেশি ঝাল মশলা খেতে পারেনা। সব খাবার রেডি, শুধু ওদের বলেছি পৌঁছানোর দশ-পনেরো মিনিট আগে আমাকে একটা ফোন দিতে। তখন পেঁয়াজ বেরেস্তা করে নেহারীতে একটু বাগাড় দিয়ে দিবো।
আমার বয়স আটষট্টি বছর। এই গতবছর চাকরি থেকে অবসর নিলাম। আল্লাহর রহমতে এখনও আমি পুরোপুরি সুস্থ এবং স্বাবলম্বী। গতবছর পর্যন্ত তো অফিসের কাজ, ঘরের কাজ সব একা হাতে সামলিয়ে প্রায় প্রত্যেক উইকেন্ডেই পদের পদের রান্না করে বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত করে খাইয়েছি। সেই বন্ধু-বান্ধবরাই এখন আমার ছেলেদের নামে কুৎসা রটায়। কত বড় সাহস এদের? আমি আরও কিছুদিন অনায়াসে আমার নিজের বাড়িতে একা একা থেকে যেতে পারতাম। কিন্তু আস্তে আস্তে নিজেকে গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। কখন কী হয়ে যায় বলা যায়না। আমার সুস্থ-সবল স্বামী তো বলা নেই কওয়া নেই দুম করে আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। এক বেলার বুকের ব্যাথা, তারপর কিছু বুঝে উঠার আগেই সব শেষ। পাঁচ বছর আগের কথা, সে সময় তার রিটায়ারমেন্টের প্রায় সময় হয়ে এসেছিলো। ঠিক করেছিলাম তার সাথে সাথে আমিও আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিবো। দুই ছেলে মাশাল্লাহ ভালোমতো সেটেল হয়ে গিয়েছে। তারাও তাদের পরিবার নিয়ে সুখে আছে। জীবনে আমরা অনেক খাটা-খাটুনি করেছি। ভেবেছিলাম দুজনে মিলে বাকিটা সময় ঘুরে বেরিয়ে আনন্দ করে কাটিয়ে দিবো। আমাদের ভাবাভাবি দিয়ে তো আসলে কিছু আসে যায়না। আমাদের চেয়েও আরও বড় ভাবনা যার তাঁর ভাবনাই সব। সেই ভাবনা বুঝার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু সে চলে যাবার পর একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলাম। আমারও আর বেশিদিন এই পৃথিবীতে থাকতে ভয় হয়। বার্ধক্যের ভয়, কারও উপর মুখাপেক্ষী হবার ভয়, পরাধীন জীবনের ভয়।
আর দশটা বাংলাদেশী পরিবারের মতো ছিল আমাদের প্রবাস জীবন। দুজনে চাকরি করেছি, সংসার করেছি, ছেলেদের মানুষ করেছি। চরকির মতো জীবন চলতো আমাদের, কোনো ফুরসত ছিলোনা। আমার স্বামী ভীষণ কড়া মানুষ ছিল। ছেলেদের কড়া শাসনে বড় করেছে সে। শুধু ছেলেদের কেন স্ত্রীকেও শাসন থেকে ছাড় দেয়নি। একটু এদিক ওদিক হলেই তার মেজাজ আকাশে চড়ে যেত। তার মেজাজ মর্জি বুঝে আমি আর আমার দুই ছেলে সবকিছু ম্যানেজ করতাম। তবে মেজাজ থাকলেও স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা ছিল ষোলো আনার জায়গায় বত্রিশ আনা। উপরে উপরে কড়া ভাব দেখালে কী হবে, স্ত্রীর রূপে গুনে সে ছিল ভীষণ মুগ্ধ। সব ব্যাপারে তার কড়াকড়ি, বিধিনিষেধ থাকলেও কোনো কিছু আদায় করে নেওয়ার পদ্ধতি আমার ভালোমতোই জানা ছিল। কখনও একফোঁটা চোখের জল আর কখনওবা একটু আহ্লাদ, ব্যস এতেই পাষান হৃদয় মুহূর্তে গলে একেবারে পানি হয়ে যেত। দুই ছেলের কাছে মায়ের প্রতি তাদের ভীষণ কড়া আর মেজাজী বাবার মুগ্ধতা আর ভালোবাসা নজর এড়ায়নি। সেজন্য ছেলেরাও তাদের মাকে নিয়ে মুগ্ধ। মাকে ভালোবাসতে শিখেছে, সম্মান করতে শিখেছে।
আমি নিজে বাইরে দিয়ে নরম মানুষ হলেও আমার স্বকীয়তাবোধ খুবই প্রবল। নিজের মতো করে গুছিয়ে সংসার করেছি। আমার সংসারে কারও হস্তক্ষেপ, কারও মাতব্বরি কখনও ভালো লাগেনি। তাই ছেলেরা বিয়ে করার আগেই বলে দিয়েছি যে তারাও যাতে নিজের মত আলাদা করে সংসার গুছিয়ে নেয়। তাদের প্রয়োজনে, সুখে-দুঃখে আমরা তো সবসময়েই আছি আর আমাদের সুখে-দুঃখে আছে তারা। একটু দূরত্ব থাকলে সম্পর্কটা অটুট থাকে, ভালোবাসার বন্ধনটা থাকে দৃঢ়। এটা অবশ্য আমার ধারণা, সঠিক নাও হতে পারে। সঠিক বেঠিক নিয়েও আমার মাথাব্যথা নেই। যার যার জীবনদর্শন তার তার কাছে। আমার জীবনদর্শন অনুসারে আমি আমার জীবন চালনা করার চেষ্টা করেছি, সবসময় যে পেরেছি তা না কিন্তু চেষ্টা করেছি। আমার স্বামী এভাবে হুটকরে চলে যাবার পর হঠাৎই খুব একাকিত্ব বোধ করছিলাম। গতবছর রিটায়ার করার পর একাকিত্বটা যেন আরও বেড়ে যায়। মনের শূন্যতা শরীরের উপর প্রভাব ফেলে, তাই শরীরটাও ভালো যাচ্ছিলোনা। ছেলেরাও ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পেরেছিলো। আমাকে নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিলোনা। ছেলেরা দেখলাম পালা করে নিজেদের সংসার বাদ দিয়ে কখনও সপরিবারে কখনও বা একা একাই উইকেন্ড হলে গাট্টি-বোঁচকা বেঁধে নিয়ে আমার সাথে থাকা শুরু করে দিলো। আমি মানা করলেও শুনতোনা। আর আমাকে তাদের বাড়িতে গিয়ে থাকার জন্যও ভীষণ পীড়াপীড়ি করা শুরু করে দিয়েছিলো। তারা তাদের মাকে ভালোমতো চিনে। পাকাপাকি থাকার কথা কেউ বলেনি কিন্তু লম্বা সময় ধরে তাদের বাড়িতে বেড়ানোর কথা প্রতিনিয়ত বলা শুরু করেছিল। ছেলেদের বাড়িতে আমি সুযোগ পেলেই গিয়ে থেকে আসি। আগেও করতাম, এখনও করি, নাতি নাতনিদের টানে করি, ভালো লাগে। কিন্তু আমি ভেঙে পড়েছি দেখে সেখানে থাকার ব্যাপারটা সেসময় মেনে নিতে পারিনি। ছেলেরা অবশ্য বলেছিলো যে তারা আমাকে নিয়ে মোটেও চিন্তিত না। শুধু তাদের শখে আমার সাথে থাকতে চায় তারা। ইশ, মায়ের একটু বয়স হয়েছে দেখে তারা ভেবেছে মা বোকা হয়ে গিয়েছে? তারা আমার নারী ছেঁড়া ধন। তাদের মনের খবর আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন রাতের বেলা বাসার সিঁড়ি বেয়ে ট্রেতে করে পানির জগ আর গ্লাস উপর তলায় নেওয়ার সময় স্লিপ করে পড়ে গিয়ে যা তা অবস্থা করে ফেললাম। একা একা ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ে থেকে অনেক কষ্ট করে জীবনের সব শক্তি সঞ্চয় করে শেষে উঠতে পেরেছিলাম। তারপর মোবাইল ফোনটা খুঁজে পেয়ে অগত্যা অ্যাম্বুলেন্স আর ছেলেদের সাথে যোগাযোগ করতে হলো। তখনই সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম। আর একা থাকা না, একাকীত্বই আমাকে অসুস্থ করে তুলবে, বুড়ি বানিয়ে ছাড়বে। তারপর ছেলেদেরকে অনেক আদর করে বুঝিয়ে শুনিয়ে আমার বাড়িটা ভাড়া দিয়ে সেই খরচেই এই রিটায়ারমেন্ট হোমে উঠে এলাম।
আমার এই কম্পাউন্ডে আমার বয়সী কয়েকজন মহিলা আছে। এর মধ্যে দুইজন আবার ভারতীয়। বাকিরা সব ইংলিশ। সকাল সকাল আমরা সবাই চা নাস্তা নিয়ে কম্যুনাল লিভিং রুমে চলে যাই। তারপর সেখানে আমাদের চলে ম্যারাথন আড্ডা। ব্রিটিশ পলিটিক্স, সাম্রাজ্যবাদী, কলোনাইজেশন, আমাদের চাকুরী জীবনের অভিজ্ঞতা, রেসিজম, টেরোরিজম, মিডলইস্ট ক্রাইসিস, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, গান, বাজনা, সিনেমা, ওয়েস্ট এন্ড মিউজিক্যাল, আমাদের দাম্পত্য জীবন, আমাদের যৌবনের প্রেমকাহিনী, রান্নার রেসিপি, উল বোনার তরিকা, হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের ব্লাউজের কাট, পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা আমাদের আলোচনায় আসেনা। আমাদের দেখে মনে হয় যে পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনার মহান দায়িত্ব আমাদের উপর আরোপিত হয়েছে আর আমরা সেই দায়িত্ব অতি যত্ন সহকারে পালন করছি। সম্প্রতি আমরা সবাই মিলে পাগলের মতো উলের কাজ করছি। আমাদের সবার ছেলেমেয়ে, নাতি নাতনিদের মনে হয় এই জীবনে আর কোনোদিন উলের কোনো কিছু কেনার প্রয়োজন পড়বেনা। উলের কাঁটায় ঘর তুলতে তুলতে আমাদের চলে তর্ক বিতর্ক আর আড্ডা। আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের তিন মহিলা আবার বিশেষ অতিথিপরায়ণ। আমরা পালা করে সবাইকে রান্না করেও খাওয়াই। আমাদের দেখাদেখি আবার আমাদের ইংলিশ বান্ধবীরাও আজকাল নতুন নতুন বেকিং করে আমাদের খাওয়ানো শুরু করেছে। উল বোনার সাথে সাথে আবার শুরু হয়েছে বেকিংয়ের ক্রেজ। এছাড়া দল বেঁধে সবাই মিলে মাঝে মাঝে শরীরচর্চা করি, মেডিটেশন করি, বাইরে বেরিয়ে আসি, সিনেমা দেখি, রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসি, বেসুরো গলায় গান বাজনা করি। ভালোই কেটে যাচ্ছে আমার জীবন। আর কারও ছেলেমেয়েরা বেড়াতে আসলে তো সবার মধ্যেই এক ধরণের আনন্দ উত্তেজনা কাজ করে। আজকে আমার ভারতীয় বান্ধবীরা ছেলের পরিবারের জন্য রসমালাই আর লাড্ডু বানাচ্ছে আর ইংলিশ বান্ধবীরা সবাই মিলে নানান ধরণের কেক আর প্যাস্ট্রি বানিয়ে হুলুস্থুল করে ফেলছে। এই নতুন জীবন আমার মন্দ লাগেনা, গত পাঁচ বছরের জং ধরা শরীর আর মনটায় যেন একটু তেল পড়ে সচল হয়েছে।
আমার এই নতুন জীবনে আমার বাংলাদেশী দুয়েকজন বান্ধবীদের শামিল করার চেষ্টাও করেছিলাম। বিশেষ করে আমার মতো দুইজন বিধবা বান্ধবীকে। এদেশে যেহেতু বাড়িতে কাজের মানুষ থাকেনা, একটু বয়স হয়ে গেলে একদম একা থাকাটা একটু কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও অনেকে কষ্ট করে ম্যানেজ করে নেয়। আমার সেই বান্ধবীদের একজন অবশ্য ছেলের সাথে থাকে আর আরেকজন নিজের বাড়িতেই মেয়ের পরিবার নিয়ে থাকে। ছেলে, মেয়ে, বউ, জামাই নিয়ে তাদের প্রায়ই নানান ছোটোখাটো অভিযোগ থাকে। বড় কিছু না কিন্তু সবাই একসাথে থাকতে গেলে যা হয়। কিন্তু আমার এরকম অলুক্ষুনে প্রস্তাব শুনে তারা রীতিমতো আঁতকে উঠেছিল। আমার মতো এরকম বৃদ্ধাশ্রমে উঠার আগে তাদের যেন মৃত্যু কাম্য। ওদের কথা শুনে আমার মনে হয়েছে যে আমাদের সমাজে, বিশেষ করে বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের প্রতি একটা বিরূপ মনোভাব থাকার কারণে দেশের বৃদ্ধাশ্রমগুলোর এমন দীনহীন অবস্থা। উন্নত ব্যবস্থা সম্পন্ন বৃদ্ধাশ্রম তেমনভাবে মনে হয় গড়ে উঠছেনা যা থেকে আমার মতো অনেকেই হয়তোবা উপকৃত হতে পারে। ইংল্যান্ডেও ভারতীয় মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র এবং খুবই সুব্যবস্থা সম্পন্ন অনেক বৃদ্ধাশ্রম দেখেছি। যেখানে একই ভাষাভাষী, একই কৃষ্টি, কালচারের সমভাবাপন্ন মহিলারা একসাথে থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশীরা বৃদ্ধাশ্রমের নাম শুনলেই এমন নাক সিটকায় যে মনে হয় বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া আর জাহান্নামে যাওয়া যেন একই ব্যাপার। তবে সবার জন্য বৃদ্ধাশ্রম উপযুক্ত না। যেমন আমার এই দুই বান্ধবীর জন্য না। ছেলে-বউ, মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনিদের নিয়ে নিত্য টানাপোড়েন, মান-অভিমান, আনন্দ-ভালোবাসা তাদের জীবনের নিত্য সঙ্গী, তাদের জীবনের আনন্দ। সেই প্রতিদিনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে তাদের বৃদ্ধাশ্রমের এই জীবন ভালো লাগবেনা, যেমন আমার ভালো লাগবেনা নিজের স্বাধীনতার সাথে আপোষ করে বা কিছুটা নির্ভরশীল হয়ে পাকাপাকিভাবে ছেলেদের সাথে থাকা। যার যার জীবনদর্শন তার তার কাছে, যে যার জীবন নিয়ে খুশি থাকলেই তো হয়। আমার যেমন কোনো অধিকার নেই তাদের বেছে নেওয়া পথকে খারাপ চোখে দেখা, তাদেরও তেমন অধিকার নেই আমার বেছে নেওয়া পথ নিয়ে চুকচুক করে দুঃখ করা। এখন থেকে ঠিক করেছি আর এরকম মিনমিন করবো। আমার বৃদ্ধাশ্রম আর বিশেষ করে আমার কলিজার টুকরা ছেলেদের সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে আসলে তাদের একেবারে দেখে নিবো।
অন্যের কাছে বৃদ্ধাশ্রম অভিশাপের মতো হতে পারে কিন্তু আমার জীবন আমি বেছে নিয়েছি, যেই জীবনে আমার প্রিয় আমার বৃদ্ধাশ্রম আর সবচেয়ে প্রিয় আমার দুই সন্তান।
© আমিনা তাবাস্সুম