আমি যেই বছর এসএসসি পরীক্ষা দিই, সেই বছরেই আবার আমার বাবার কাজের সুবাদে আমি বাংলাদেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে আসি। এরপর থেকে আমার জীবন সম্পূর্ণ নতুন দিকে প্রবাহিত হয়।
কল্পনা করেছিলাম, বিদেশের জীবন হবে খুব স্বাধীন আর আনন্দময়। কিন্তু কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে তো সবসময় মিল থাকে না। ইংল্যান্ডে এসে স্কুলে ভর্তি, বাসে বা হেঁটে একা একা স্কুলে যাওয়া রপ্ত করা, একেবারে নতুন ধরণের পড়াশোনা—সবকিছু মিলিয়ে সেটেল হতে হতে কয়েক মাস লেগে গেলো। আমি ছোটবেলায় কিছুটা চুপচাপ, শান্তশিষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কিছু করা, কারও সাথে যেচে বন্ধুত্ব করা আমার স্বভাবে ছিল না। নতুন পরিবেশে, নতুন পড়াশোনায় নিজেকে অভ্যস্ত করতেই রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলাম। এর চেয়ে বেশি কিছু করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার ছিল না।
কিন্তু আমার মা আমার বিপরীত চরিত্রের মানুষ। তিনি অনেক উচ্ছল প্রকৃতির। দীর্ঘ বাইশ বছরের স্কুলের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে এদেশে এসেছেন। তাই সময়ের অপব্যয় না করে এদেশের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমার বাবার চাকরির সুযোগে ডিপ্লোম্যাটিক পরিমণ্ডলের সবকিছুতে নিজেকে সংযুক্ত করে ফেললেন। বাড়ির কাছেই এক মহিলাদের হেয়ার ড্রেসার কাম বিউটি পার্লার ছিল, যা আবার আমার মায়ের কাছাকাছি বয়সী দুই ইরানিয়ান মহিলা দ্বারা চালিত। তাদের সাথে শুরুতেই বন্ধুত্ব করে ফেললেন। শুধু তাই না, তাদের বুদ্ধি অনুসারে আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে চুল কাটিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো আইব্রো থ্রেডিংও করিয়ে আনলেন।
বাসার কাছেই ছিল এক ডাক্তারের জিপি (জেনারেল প্র্যাকটিশনার) সার্জারি। আমাদের জিপি ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও আমার মা কেমন করে যেন বের করে ফেললেন যে সেই সার্জারির জিপি হলো কলকাতার বাঙালি দম্পতি এবং তাদের নাকি ইলিশ মাছ খুবই প্রিয়। এরপর থেকে তাদের নিয়মিত ইলিশ মাছ খাওয়ার জন্য আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করা শুরু করে দিলেন।
আমাদের লোকাল লাইব্রেরির মেম্বার হয়ে সেখানকার লাইব্রেরিয়ান পামেলার সাথে বন্ধুত্বও করে ফেললেন। পামেলা একজন বয়স্ক ইংলিশ মহিলা। আমার মা তাকে চা-নাস্তার নিমন্ত্রণ করলেই সে খুশি মনে হাজির হয়ে যেত আর গোগ্রাসে তার সবচেয়ে প্রিয় ইন্ডিয়ান ফুড উদরস্থ করার সাথে সাথে আমার মাকে ইংরেজির লেসন দিতো। এছাড়াও এক কলেজে টিচিং-এর উপর একটি কোর্স করা, এক স্কুলে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করা, আমাদের বাড়ির সামনের এক বয়স্ক ইংলিশ দম্পতির ডেকোরেশন পিসের দোকান থেকে প্রতিনিয়ত ডেকোরেশন পিস কিনে বাসা ভরিয়ে ফেলা, আমাকে বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করা—এধরণের তার নানাবিধ কার্যকলাপের ফিরিস্তি দিতে গেলে আমার এই লেখা শেষ হবে না।
আমার মা এই সবকিছু নিয়ে মহা ব্যস্ত থাকলে তো কোনো ঝামেলা ছিল না। ঝামেলা হলো আমাকেও তার মতো করে বিভিন্ন কার্যকলাপে জড়িত হওয়ার জন্য সদা পরামর্শ দান করতেন। নতুন পরিবেশে, যেখানে আমি নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারলেই বাঁচি, সেখানে এত কিছু করার পরামর্শ আমার কাছে ছিল বিশেষ পীড়াদায়ক।
আমাদের বাড়ির উল্টোদিকেই এক লন্ড্রি ছিল। সেই লন্ড্রির মালিক অল্পবয়সী হাসিখুশি এক কৃষ্ণাঙ্গ লোক। সে আর তার এক সহকারী, দুইজনে মিলে সেই লন্ড্রি চালাতো। বলাই বাহুল্য, তাদের দুজনের সাথেও আমার মায়ের ছিল বিশেষ বন্ধুত্ব। সেই সহকারী রবিবারে কাজ করতো না, তাই রবিবারে নয়টা থেকে চারটা পর্যন্ত একজন সহকারীর প্রয়োজন হতো। বিষয়টা জানতেই আমার মায়ের মাথায় এক বুদ্ধি এলো। তার সেই বন্ধুকে সুপারিশ করে রবিবারে তার সহকারী হিসেবে আমার কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন।
ঘটনা শুনে তো আমি একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। আমি নতুন দেশে, নতুন মানুষ, নতুন পড়াশোনা নিয়ে অনেক হিমশিম খাচ্ছি। রবিবারটা আমার এ-লেভেলের জন্য পড়াশোনা করা দরকার। তা বাদ দিয়ে আমি কী কুক্ষণে কাজ করতে যাবো? মায়ের কাছে আমার এই যুক্তি টিকলোই না। তার কথা, জীবনে সব করতে হবে। পড়ার সময় পড়া, কাজের সময় কাজ, ফুর্তির সময় ফুর্তি। যদিও তখন আমার মোটেও অর্থ উপার্জনের কোনো প্রয়োজন ছিল না আর সেই ব্যাপারে আমার মায়ের কোনো দৃকপাতও ছিল না, তার কথা হলো অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। এদেশে সবাই নাকি খেটে খায়, সবাই শ্রমজীবী, তাই আমাকেও কষ্ট করা শিখতে হবে।
আমার বড় ভাই এখানে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই পাশাপাশি কাজ করে ইতিমধ্যে মায়ের সুনজরে আছে। সেও আমার মায়ের সাথে তাল মিলালো। আমি পড়লাম মহা ঝামেলায়।
তবে সত্যি কথা বলতে কী, আমি পড়াশোনার জন্য যতটা না কাজের ব্যাপারে অনিচ্ছুক, তার চেয়েও অনিচ্ছুক ছিলাম অন্য কারণে। আমার তখনকার মনমানসিকতা অনুসারে এই কাজটি আমার চোখে ছিল খুবই তুচ্ছ। সেসময় ইংল্যান্ডে আমার বাবা যেহেতু ডিপ্লোম্যাট হিসেবে ছিলেন, সেহেতু অর্থের প্রাচুর্য না থাকলেও বিভিন্ন ধরণের সুযোগ-সুবিধার কোনো কমতি ছিল না। দেশ থেকে ডোমেস্টিক ওয়ার্কার হিসেবে আমাদের কাজের বুয়াও আমাদের সাথে এসেছে। বাবার অফিস থেকে পাওয়া হতো গাড়ি আর ড্রাইভার। সেই ড্রাইভার আমাকে মাঝে মাঝে স্কুলে নামিয়ে দিলে আমার সহপাঠীরা মনে করতো না জানি আমি কোথাকার কোন নবাবজাদী, শোফার চালিত গাড়িতে করে স্কুলে আসি।
আর সেখানে কিনা আমাকে সারাটা দিন অন্যের আধোয়া ময়লা কাপড় বাছাই করার কাজ করতে হবে? আমার মনে হয়েছিল এর চেয়ে কচুগাছে গলায় দড়ি দিয়ে মরা ভালো। আমার মাকে এসব বলে লাভ নেই। তাই শুধু লেখাপড়ার অজুহাতই দিলাম। কিন্তু আমার মাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলানো গেল না। অগত্যা, প্রতি রবিবার সাত ঘণ্টা বুকে পাথর বেঁধে আমাকে অন্যের ময়লা কাপড় বাছাই করা, রিসিট বানানো আর বিলের টাকা গোনার কাজে অতিবাহিত করতে হতো। একেকজন কাস্টমার দোকানে ঢুকতো আর লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যেত। না জানি তারা আমাকে দেখে কী ভাবছে! কী মর্যাদাহানিকর কাজটাই না আমি করছি। প্রতিটা মুহূর্ত বিষের মতো মনে হতো।
তখন আমি বুঝিনি যে আমাদের দেশের সমাজ থেকে গ্রহণ করা শিক্ষায় আমার কাছে “শ্রমের মর্যাদা” মানে শুধুমাত্র বাংলা দ্বিতীয় পত্রের রচনা। রচনায় বড় বড় “বাত কি বাত” করার বাইরে নিজের জীবনে প্রয়োগ করার মতো বিন্দুমাত্র শিক্ষাও আমি গ্রহণ করতে পারিনি। তবে এর একমাত্র ইতিবাচক দিক ছিল যে প্রতি রবিবার ঘণ্টায় পাঁচ পাউন্ড করে পঁয়ত্রিশ পাউন্ড আমার আয় হতো। সতেরো বছরের একটা মেয়ের জন্য প্রয়োজন ছাড়াই এই বাড়তি পঁয়ত্রিশ পাউন্ড আমার কাছে নতুন একটা ব্যাপার মনে হয়েছিল। জীবনে প্রথম নিজের শ্রমার্জিত আয়ের মূল্য কিছুটা হলেও অনুধাবন করেছিলাম।
তারপরও আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল কীভাবে এই কাজ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। লেখাপড়ার দোহাই দিতে দিতে আমি যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, তখনই আমার স্কুলের দেওয়ালে এক বিজ্ঞাপন দেখতে পেলাম। “কুমন” নামে ছোটদের অঙ্ক আর ইংরেজির এক কোচিং সেন্টারের সহকারী নিয়োগ হবে। সপ্তাহে দুই দিন স্কুলের পর তিন ঘণ্টা করে বাচ্চাদের সহজ হোমওয়ার্ক আর ক্লাসওয়ার্কের খাতা মার্ক করতে আগ্রহী এ-লেভেলের ছাত্রছাত্রীরা আবেদন করতে পারে।
আমার মতো মুখচোরা মেয়েও সাহস করে একটা ফর্ম পূরণ করে পাঠিয়ে দিলাম। দুই দিন পর বাড়ির ফোনে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক, তারপর অল্প কিছু কথাবার্তা আর সহজ একটা পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাকাপোক্ত। অতঃপর এই নতুন চাকরির সুবাদে আমার ময়লা কাপড় বাছাই করার চাকরি থেকে রেহাই।
এতো গেলো দীর্ঘ বাইশ বছর আগের কথা। এই বাইশ বছরে আমি আর কখনও কাজ ছাড়া থাকিনি। কুমন কোচিং সেন্টারের কাজের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দুইটি সুপারস্টোরে টানা কাজ করেছি। কাজ নিয়ে আর কখনো বাছবিচার করিনি। গ্র্যাজুয়েশনের পর যতদিন পর্যন্ত না আমার পড়াশোনার বিষয়ক কোনো চাকরি পেয়েছি, ততদিন যে কাজ পেয়েছি, সে কাজই ফুলটাইম হিসেবে করেছি। দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা নিয়েও কাজ চালিয়ে গিয়েছি। অনেকের বিবেচনায় যেই কাজ প্রয়োজন ছাড়া অযথা দিনরাত খাটুনি, তা আমার কাছে মনে হয়েছে একান্ত প্রয়োজনীয়। কেননা ততদিনে আমি উপলব্ধি করেছি যে নিজের শ্রমার্জিত অর্থ যত সামান্যই হোক না কেন, একজন মানুষের জীবনে তার অবদান অসামান্য। ঠিক যেন রজনীকান্ত সেনের “স্বাধীনতার সুখ” কবিতার সেই বাবুই পাখির “নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর ঠাসা” এর মতো।
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার মা যদি আমাকে জোর করে সেই সময় সেই লন্ড্রির কাজে ঢুকিয়ে না দিতেন, তাহলে জীবনের সবচেয়ে বড় একটা উপলব্ধি থেকে হয়তো বঞ্চিত হতাম। আমি যখনই লন্ড্রিতে কাজ করা সময়কালীন আমার নিজের চিন্তাধারা আর সংকীর্ণ মনোভাবের কথা মনে করি, তখনই লজ্জায় নিজের অজান্তেই মাথা হেঁট হয়ে যায়।
আমি উচ্চাকাঙ্ক্ষী নই, কখনো ছিলামও না। তবে এই লজ্জার উপলব্ধি আমাকে শুধরে নিয়ে কিছুটা হলেও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে, বিভিন্ন ধরণের কাজ করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, সর্বোপরি আমাকে স্বনির্ভর করে তুলেছে। শুধুমাত্র আর্থিকভাবে স্বনির্ভর না, মানসিকভাবে এবং শারীরিকভাবেও বিভিন্ন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলার জন্য যে স্বনির্ভরতার প্রয়োজন, তা অর্জন করতে শিখিয়েছে।
আজ আমি পৃথিবীতে শ্রমজীবী মানুষদের সবচেয়ে সম্মান করি। বিশেষ করে শ্রমজীবী মহিলাদের এবং মায়েদের। সেই শ্রমজীবী মহিলা কোনো নামকরা সংস্থার সিইও হোক, অথবা বাংলাদেশের নির্মাণকাজে সাহায্যকারী ইটভাঙার মহিলাই হোক। তাদের কষ্ট, শ্রম এবং অবদান দেখলে নিজের অজান্তেই তাদের প্রতি সম্মানে আমার মাথা নত হয়ে যায়।
© আমিনা তাবাস্সুম