Ameena Tabassum

মিস্টার কবলি

(১)

আমি যখন ইংল্যান্ডে আসি তখন আমার বয়স সবেমাত্র সতেরোতে পড়লো। সেসময় আমি বাংলাদেশে কলেজের প্রথম বর্ষের নতুন ছাত্রী ছিলাম। বাবার চাকরির সুবাদে এদেশে আসা। কলেজ শুরু করা মাত্রই বাবার পোস্টিংয়ের খবর পেলাম। তারপর কি আর আমার অতি কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলে বাঁধা মেয়েদের কলেজের জীবন আর এইচএসসির কঠিন পড়াশোনা ভালো লাগে?

নতুন দেশের নতুন জীবনের স্বপ্নে তখন বিভোর আমি। বিলেতে আসা মাত্রই জীবন হবে স্বাধীন আর পড়াশোনার চাপমুক্ত। সবচেয়ে উত্তেজনার বিষয়—ইংল্যান্ডে নিশ্চয়ই আর মেয়েদের কলেজে পড়তে হবে না।

সবে মাত্র তখন “লা নুই বেঙ্গলি” বইটি পড়েছি। খাঁটি বাঙালি মৈত্রেয়ী দেবীর সাথে রোমানিয়ান যুবক মির্চা এলিয়াদের প্রেমের বর্ণনা তখন একেবারে মনে গেঁথে আছে। ব্রিটেনে আসামাত্র চোখের সামনে মির্চা এলিয়াদের মতো কত শত যুবক থাকবে। পৃথিবীটা তো খুব নিষ্ঠুর নিশ্চয়ই না। তার মধ্যে কোনো এক যুবক হয়তো আমার মতো কৃষ্ণকায়, শীর্ণকায়, অতিরিক্ত সাদামাটা বাঙালি মেয়ের প্রতি একটু হলেও আকৃষ্ট হবে।

ইংল্যান্ডে এসেই নর্থ লন্ডনের হ্যারোতে এক স্কুলে এ-লেভেল করার জন্য ভর্তি হলাম আমি। সম্পূর্ণ বাংলা মিডিয়াম থেকে আসা একটি মেয়েকে সরাসরি এ-লেভেলে ভর্তি করতে সেখানকার হেডটিচার প্রথমে একটু উদ্বিগ্ন হলেও শেষপর্যন্ত আমাকে ভর্তি করে নিলেন।

তবে কল্পনা আর বাস্তব জীবনের মধ্যে অনেক তফাৎ। স্কুলের প্রথম দিনই বড়সড় ধাক্কা খেলাম। হ্যারো মূলত এশিয়ানদের জায়গা (বেশিরভাগই গুজরাটি), আর তাই স্কুলের বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীও এশিয়ান, আমার মতোই দেখতে। তবে সবার মধ্যে আমাকে মনে হয় আলাদা করে চেনা যেত। হাজার হলেও তাদের সবার জন্ম আর বেড়ে ওঠা এখানে, আর আমি তো একেবারেই ফ্রেশি। তাই বলে বিদেশে এসে বিদেশি দেখতে ছেলেমেয়েদের সাথে পড়াশোনা করবো না, এটা কেমন কথা?

শুরুতেই আমাকে ক্লাসের টাইম টেবিল ধরিয়ে দিয়ে একজন সহপাঠীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। সে আমার বাডি (buddy) হিসেবে প্রথম কিছুদিন আমাকে নতুন দেশে নতুন স্কুলের নিয়ম-কানুন, রুটিন, কোথায় কোন ক্লাস—এসব সব বিষয়ে সাহায্য করবে।

নিমেষের মধ্যেই আমার পড়াশোনা-বিহীন স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। কঠোর বাস্তবতা আর প্রতিবন্ধকতার সাথে পরিচয় হলো আমার।

প্রথম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হলাম ইংরেজি বোঝা আর বলা নিয়ে। দেশে থাকতে স্কুলে ইংরেজি পড়েছি, লিখেছি, মুভি, সিরিয়াল দেখেছি, কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলার প্রয়োজন তো কখনও হয়ে ওঠেনি। এখানে স্কুলে কাজ চালানোর মতো ইংরেজি বলতে পারলেও সতেরো বছরের একটা মেয়ের বন্ধু-বান্ধবীর সাথে মন খুলে ইংরেজিতে কথা বলার মতো পারদর্শিতা আমার ছিল না।

তাছাড়া ব্রিটিশ অ্যাকসেন্ট এবং বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার বুঝতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল। আমার সাথে যেই সহপাঠীকে বাডি হিসেবে দেওয়া হয়েছিল তার গ্রুপে আমি সবসময় ভিড়ে থাকতাম ঠিকই, কিন্তু তারা যখন কে কাকে “ফ্যান্সি” করে অথবা কার ছেলে বন্ধু বেশি “লোডেড” এসব বলে হাহা হিহি করতো, আমার বুকটা হুহু করে কেঁদে উঠতো।

আমার দেশে ফেলে আসা বান্ধবীরাও নিশ্চয়ই ক্লাসের ফাঁকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এমন করেই মন খুলে হাহা হিহি করছে। আমার মনে হতো, সারা পৃথিবীর মেয়েরা মন খুলে কথা বলছে, হাসছে, কাঁদছে, আর নিয়তির হঠাৎ নিষ্ঠুর ছোবলে শুধু আমারই মন খুলে কথা বলা চিরতরে বন্ধ।

আমার প্রথম ক্লাস ছিল অংকের। টিচারের নাম মিস্টার কবলি। ছয় ফুটের উপর লম্বা, মোটাসোটা, বিশালাকৃতির, ধবধবে সাদা লম্বা দাড়ি আর চুলের মিস্টার কবলি যেন অবিকল ইংরেজি সিনেমার স্যান্টা ক্লস। ভারী গমগমে গলায় জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে কথা বলতেন মিস্টার কবলি।

আমার বাডি সহপাঠী ক্লাসে আমাকে নিয়ে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই তিনি যেন হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন,
—”জিসিএসসি কোথায় করেছ?”
আমি এমনিতেই তখন অনেক নার্ভাস, তার কথা শুনে একেবারে সিঁটকে গেলাম। কোনো রকমে বলে উঠলাম,
—”জিসিএসসি করিনি, কিন্তু তার ইকুইভ্যালেন্ট এসএসসি বাংলাদেশ থেকে করেছি।”
তিনি একটু তাচ্ছিল্যের স্বরে যেন বলে উঠলেন,
—”ইকুইভ্যালেন্ট? আই সি?”
তার কথার টোন শুনে আমার চোখ ফেটে কান্না বের হয়ে আসতে চাইছিল। কোনো রকমে অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামাল দিলাম। ক্লাসে সবার সামনে কেঁদেকেটে শেষে বেইজ্জতি ব্যাপার না হয়ে যায়।
এরপর টুকটাক আরও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন তিনি। কিছু বুঝলাম, কিছু বুঝলাম না, আর বেশিরভাগ কথার উত্তরই দিতে পারলাম না।
তারপর সারাটা ক্লাস অংক করা তো দূরের কথা, কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করতেই কেটে গেল আমার।
ক্লাস শেষে মিস্টার কবলি আমার সামনের অংকের কাগজগুলোতে এলোমেলো আঁকিবুকি দেখে চিন্তিত মুখে বলে উঠলেন,
—”ইউ আর গোয়িং টু বি এ ট্রাবল মেকার।”

(২)

এরপর থেকে ক্লাসে মিস্টার কবলির তার “ট্রাবল মেকার”-এর প্রতি সবসময় থাকতো করা নজর। তার এই নজরদারি আমার ছিল দুই চোখের বিষ। ভাবতাম, এই বুড়া তো একেবারেই বুড়া, রিটায়ার করে না কেন? রিটায়ার না করলে না করুক, মরতে তো পারে?

ক্লাসে একদিন সে লগারিদমের অঙ্ক করাচ্ছিল। যে কোনো টপিক বুঝিয়ে সাধারণত সেই টপিকের উপর কিছু প্রবলেম সবাইকে সলভ করতে দেওয়া হতো। শুরুর দিকের প্রবলেমগুলো হতো সহজ, তারপর আস্তে আস্তে কঠিন, আর সবচেয়ে শেষের প্রশ্নটা থাকতো চ্যালেঞ্জ প্রশ্ন হিসেবে।

মিস্টার কবলি সেকেলে মানুষ। সে তার ছাত্রছাত্রীদের কড়া চাপে রাখতে পছন্দ করতো। তাই সে চ্যালেঞ্জ প্রশ্নটা এতো কঠিন করে দিতো, যাতে করে কেউ না পারে। তারপর এই না পারা নিয়ে সবাইকে একটু বকাঝকাও করতো। ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা তার এই ধরণের আচরণে অনেক হাসাহাসিও করতো।

যাই হোক, মিস্টার কবলি যথারীতি আমার লগারিদমের পেপারটা নিয়ে চোখ বুলালো। আমি সেইদিন চ্যালেঞ্জ প্রশ্নসহ সবকটা অঙ্ক নিমেষে শেষ করেছি, তাই আমার কোনো চিন্তা নেই। সে হঠাৎ আমাকে ক্লাসের সামনে ডেকে নিয়ে মার্কার পেনটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে চ্যালেঞ্জ প্রশ্নটা বোর্ডে সলভ করে সবাইকে দেখাতে বললো।

আমি হাত কাঁপাতে কাঁপাতে অঙ্ক করছি আর সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দরাজ কণ্ঠে আমার বুদ্ধির প্রশংসা করছে। হঠাৎ এরকম সবার সামনে এতগুলো প্রশংসা শুনে আমার আবার চোখ ফেটে কান্না চলে আসলো। এই কান্নার যন্ত্রণাই তো, জীবনটা দেখি একেবারে ঝালাপালা হয়ে গেল।

এরপর মিস্টার কবলি প্রায়ই টুকটাক আমার সাথে কথা বলতো। সে মনে হয় স্কুলের প্যাস্টোরাল কেয়ারের দায়িত্বে ছিল। নতুন স্কুলে কেমন সেটেল করছি, পড়াশোনা কেমন যাচ্ছে, বাকি সাবজেক্টগুলোতে কেমন করছি—এইসব নিয়ে তার অনেক প্রশ্ন। আমি তখন ম্যাথস, ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি নিয়ে এ-লেভেল করছি।

তাকে জানালাম পড়াশোনা ভালো যাচ্ছে না, কিছু বুঝি না, কিছু ভালো লাগে না। জিজ্ঞেস করলো,
—”ইউনিভার্সিটিতে কি পড়তে চাও?”
বললাম,
—”মা-বাবার ইচ্ছা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি।”
সে বললো,
—”তোমার কি ইচ্ছা?”
আমি বললাম,
—”আমারও তাই।”
—”কোন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাও?”
—”জানি না, ইলেকট্রিকাল না হয় মেকানিকাল কিছু একটা পড়বো।”
—”কেমিকাল পড়তে চাও না?”
আমি বললাম,
—”নাহ।”
—”আচ্ছা, তুমি তাহলে একটা কাজ করতে পারো। কেমিস্ট্রি বাদ দিয়ে ফারদার ম্যাথস নিয়ে এ-লেভেল করতে পারো। তুমি ফারদার ম্যাথস পারবে আর ইলেকট্রিকাল বা মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অ্যাডমিশনেও সুবিধা হবে। তাছাড়া এ বছর আর কেউ এই স্কুলে এই সাবজেক্ট করছে না। আমি তোমাকে পড়াবো আর ওয়ান টু ওয়ান ফোকাস দিতে পারবো।”
আমি বললাম,
—”আমার একজনের জন্য দুই বছর ধরে স্কুলে এই একটা এক্সট্রা সাবজেক্ট পড়ানো হবে?”
সে বললো,
—”অবশ্যই হবে।”
মা-বাবার সাথে আলোচনা করে তাকে জানালাম যে আমি তার কথা মতো ফারদার ম্যাথস নিতে চাই। আর সাথে সাথেই সে সব ব্যবস্থা করে দিলো। এরপর প্রতিদিন তার সাথে আমার ফারদার ম্যাথসের ওয়ান টু ওয়ান ক্লাস হয়। আমার কাজ দেখে কখনও সে মুগ্ধ হয়, কখনও বা যার পর নাই বিরক্ত হয়ে বলে,
—”তুমি তো দেখি আসলেই ট্রাবল মেকার।”
এর মধ্যে জানতে পারলাম এদেশে যেকোনো স্কুল থেকে বাংলায় এ-লেভেল করা যায়। স্কুল পড়াতে পারবে না, কিন্তু পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। মিস্টার কবলিকে জানালাম আমি চার নম্বর সাবজেক্ট হিসেবে বাংলাতেও এ-লেভেল করতে চাই।

সে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
—”যেগুলো আপাতত করছো সেগুলোই মন দিয়ে করে ভালো করার চেষ্টা কর। শুধু শুধু আরেকটা ঝামেলার দরকার কী?”

আমি বললাম,
—”বাংলা এ-লেভেলে ব্যাকরণ ফ্যাকরণ কিছু নেই, শুধু ভাষা আর সাহিত্যর উপর সিলেবাস। আমি এগুলোতে ভালো, তোমার কোনো চিন্তা করতে হবে না। তুমি শুধু আমার পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দাও।”

আরেকটা পরীক্ষা নিয়ে আমি শেষ মুহূর্তে একটা গড়বড় করে ফেলব মনে করে তাকে খুবই চিন্তিত দেখলাম। শেষে বললাম,
—”ঠিক আছে, বাংলা পড়তে আমার দুই বছর লাগবে না। আমি প্রথম বছরের শেষে বাংলা পরীক্ষা দেবো যাতে করে শেষ বছর যেই তিনটা সাবজেক্ট দেওয়ার কথা, সেগুলোতেই ফোকাস করতে পারি।”

অগত্যা সে রাজি হলো, কিন্তু বার বার বলতে থাকলো,
—”তুমি দেখি মহা ট্রাবল মেকার।”

যতদূর মনে পড়ে, স্পিকিং, লিসেনিং আর দুইটা রিটেন পেপার মিলিয়ে সর্বমোট চারটা পরীক্ষা ছিল বাংলার। স্পিকিং-এর জন্য স্কুলে একজন প্রবাসী বাংলাদেশি ভদ্রলোক এসেছিলেন। মিস্টার কবলি নিজেই তার তদারকি করে আমাকে পরীক্ষায় বসিয়ে দিলেন।

আমাকে বাংলায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে মনে করেই আমি মহা উত্তেজিত। কিন্তু মিস্টার কবলি দেখলাম আমার চিন্তায় অস্থির, বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন আমি ঠিক আছি কিনা।

রিটেন পরীক্ষার ইনভিজিলেটর দেখলাম মিস্টার কবলি নিজেই। পরীক্ষা শেষে খাতা নেড়েচেড়ে বার বার বলতে লাগলেন,
—”এত অল্প সময়ে তুমি এত লিখেছ? এগুলো কী ধরনের বর্ণ, দেখে মনে হচ্ছে এগুলো শুধু আঁকিবুকি।”

অবশেষে যখন রেজাল্ট বের হলো, সেই আমাকে ডেকে নিয়ে রেজাল্ট জানালেন।

বাংলাদেশের বাংলা মিডিয়ামে পড়া মেয়ে আমি। বাংলা সাহিত্য আমার অনেক প্রিয়। বাংলায় খারাপ করার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু মিস্টার কবলি আমার পেপারগুলোর নম্বর দেখে এতো মুগ্ধ যে তা দেখার মতো। তার এই অকারণ খুশি দেখে আমার আবার চোখে পানি চলে এলো।

(৩)

এরপর শুরু হলো ইউনিভার্সিটি ভর্তি অ্যাপ্লিকেশনের তোড়জোড়। আমি সবকিছু ঠিকমতো করছি কিনা সেদিকে মিস্টার কবলির কড়া নজর। তিনি আমাকে বললেন,
—”তুমি কি ইউনিভার্সিটিতে ম্যাথস পড়ার কথা কখনও চিন্তা করেছ?”

আমি বললাম,
—”ম্যাথস পড়ে কী করব? আমি বাবা তোমার মতো টিচার হয়ে ট্রাবল মেকারদের ডিল করতে পারব না।”

মিস্টার কবলি তাও বললেন,
—”কিংস কলেজ লন্ডনের ম্যাথস প্রোগ্রামটা ভালো। আমি সেখানে পড়েছি, তুমিও চিন্তা করে দেখতে পার।”

আমি বললাম,
—”তুমি তো নিশ্চয়ই মান্ধাতার আমলে পড়েছ। তার সাথে কি এখন কোনো মিল আছে নাকি?”

মিস্টার কবলি দুলে দুলে হাসলেন।

ব্রিটেনের নিয়ম অনুসারে শুরুতে পাঁচটি ইউনিভার্সিটি বা কোর্সে অ্যাপ্লাই করা যায়। পরে ইউনিভার্সিটির দেওয়া অফার অনুসারে শেষ পর্যন্ত একটি ফার্ম এবং আরেকটি ইন্সুরেন্স চয়েস হিসেবে বেছে নিতে হয়।

আমার পাঁচটি অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে কিংস কলেজের ম্যাথস ও কম্পিউটার সায়েন্স একটি ছিল। সব অফার হাতে আসার পর শেষ পর্যন্ত মিস্টার কবলির পরামর্শেই কিংস কলেজকে ফার্ম চয়েস হিসেবে বেছে নিলাম। তবে ভর্তি হতে পারব যদি অফারের শর্ত অনুসারে আমার এ-লেভেলের ফাইনাল রেজাল্ট হয়।

রেজাল্টের দিন গিয়ে দেখলাম স্কুলের ব্রেকআউট এরিয়ায় সব শিক্ষকরা খামে ভরে ছাত্রছাত্রীদের রেজাল্ট তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। বিশাল জায়গাটির একেবারে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন সবার থেকে লম্বা, বিশাল, সৌম্য চেহারার আমার সেই শিক্ষক মিস্টার কবলি।

আমাকে দেখে এমনভাবে এগিয়ে এলেন যেন তিনি আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন। তার কপট রাগ,
—”ট্রাবল মেকার, তুমি দেখি রেজাল্টের দিনও ঢিলেমি করে দেরি করে এসেছ।”

তারপর জিজ্ঞেস করলেন,
—”তোমাকে জানি কিংস কলেজে যেতে হলে কী রেজাল্ট পেতে হবে?”

আমাকে কী পেতে হবে তা আমার থেকে তিনি ভালো জানেন, আমি তাই উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। তিনি আমার মাথায় আলতো করে চাটি মেরে আমার খামটি হাতে দিয়ে বললেন,
—”আমাকে অনেক ট্রাবল দিলে কী হবে, ইউ ডিড ইট ইয়ং লেডি, অ্যান্ড আই অ্যাম ভেরি প্রাউড অফ ইউ।”

মিস্টার কবলির সাথে সেই আমার শেষ দেখা। স্বার্থপর আমি এরপর নিজের জীবন নিয়ে এতো মজে ছিলাম যে আর কোনোদিন তার কোনো খবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। তবে চোখের সামনে এখনও বিশাল, সৌম্য, ফাদার ক্রিসমাসের মতো তার মূর্তিটি ভেসে আসে।

যিনি কিনা নতুন দেশে নতুন পরিবেশে এক অসহায় ছাত্রীর অতি কষ্টে লুকিয়ে রাখা দুর্বলতা আর সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরে তাকে স্নেহ-মমতা দিয়ে ছায়া দান করেছিলেন।

দীর্ঘ উনিশ বছর পর আমি তার খবর নিতে স্কুলটিতে যোগাযোগ করি। বটবৃক্ষের মতো ছেয়ে থাকা আমার সেই মহৎ শিক্ষক আমাকে চির ঋণী করে অনেক আগেই এই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন।
(আত্মকথন)

© আমিনা তাবাস্সুম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top