(১)
আমি কালো ছিলাম বলে ছোটবেলায় আমার আদরের নাম ছিল “বেগুনী” আর “সবুজ”। “আমার বেগুনী মেয়েটা কোথায়?” অথবা “আমার সবুজ মেয়েটা কোথায়?”—অফিস থেকে ফিরেই আদর করে আমার বাবা আমাকে ডাকাডাকি শুরু করে দিতেন। বাবার কাছ থেকেই আমার এই কালো গায়ের রং পাওয়া, সেকারণে তাঁর একটু মনোকষ্ট ছিল। “বেগুনী” আর “সবুজ” ছিল তাই নিছক আদরের ডাক। বাকিদের কাছে আমি ছিলাম শুধু “কালো” অথবা আমার গায়ের রং “ময়লা”।
আমার এই “ময়লা” গায়ের রংটা বিশেষ লক্ষণীয় হওয়ার অবশ্য একটা কারণ ছিল। সেসময় আমার বড় ভাই এবং বাবা-মায়ের দিকের আমার সব কাজিনদের গায়ের রং ছিল একেবারে দুধে আলতায়। সবাই যেখানে যেকোনো রঙের কাপড় পরতে পারতো, সেখানে আমাকে পরানো হতো হালকা রঙের কাপড়। তার মধ্যে হালকা গোলাপি আর ঘিয়া রঙটাই আমার জন্য বেশি বেছে নেওয়া হতো।
এই হালকা গোলাপি আর ঘিয়া এখনো আমার মাথায় এমনভাবে চেপে বসে আছে যে এই দুটো রঙের বাইরে যেতে আমাকে রীতিমতো বেগ পেতে হয়। কালো হওয়ার কারণে মনে মনে আমার অনেক দুঃখ ছিল। প্রায়ই আমি নিজের মনেই সৃষ্টিকর্তার কাছে এই নিয়ে অভিযোগ করতাম। আমার মনে হতো সৃষ্টিকর্তার এ কেমন পক্ষপাতিত্ব?
(২)
সেই “ময়লা” গায়ের রঙের সময় আমি পার করে এসেছি। অথবা জয় করে এসেছি বললেই ঠিক হবে। আমার গায়ের রং এখন আমার কাছে আর কোনো ব্যাপার না। সত্যি কথা বলতে কী, এটা একসময় আমার কাছে বিশাল ব্যাপার ছিল মনে করলেই ভীষণ অবাক লাগে। ভেবেছিলাম শুধু আমার কাছে কেন, এই যুগে কারও কাছেই এটা আর কোনো ব্যাপার না।
কিন্তু ভাবনাটা কি আসলেই ঠিক?
আজ আমার পনেরো বছরের একটা মেয়ে আছে। আমার মেয়েটা ব্রিটেনে প্রথম স্কুল শুরু করার কয়েক মাস আগের কথা। স্কুল শুরুর আগে তাদের নতুন ক্লাসের সব বাচ্চাদের সাথে স্কুলে “সেটলিং ইন সেশন” হয়েছিল। নতুন বাচ্চাগুলোকে একে অপরের সাথে পরিচিত করার জন্য এই “সেটলিং ইন সেশন” এদেশে বেশ প্রচলিত।
সেইদিন ক্লাসের তিরিশটা ছোট ছোট বাচ্চাদের একসাথে একটা ছবি তুলে সবার কাছে এক কপি করে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাবা-মায়েদের বলে দেওয়া হয়েছিল ছবিটা এমন কোথাও রেখে দিতে যাতে করে বাচ্চারা ছবিটা দেখে সব মুখগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে যায়।
আমার চার বছরের মেয়েটা দেখলাম সেই ছবিটা কোথাও রাখতে চায় না এবং দেখতেও চায় না। সেই ছবিটা দেখলেই সে কেমন মন খারাপ করে ফেলে। অনেক তদন্তের পর জানতে পারলাম কেন মেয়ের সেই ছবির প্রতি এত অনীহা। তিরিশটা বাচ্চার মধ্যে একমাত্র এশিয়ান চামড়ার আমার চার বছরের ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটার মনে হয়েছে সে এতো কালো কেন?
আমি তো অবাক, কোথা থেকে সে এই ধারণা পেলো?
এরপর আর আমার মেয়ের কাছে “কালো” নিয়ে কোনো অভিযোগ শুনিনি। তবে গল্পচ্ছলে ছোটোখাটো ঘটনা দুই-একবার বলেছে। যেমন, ছোট মেয়েরা মিলে খেলার সময় সে লিটল মারমেইড হতে চাইলে তাকে বলা হয়েছে, “মারমেইড ক্যাননট বি সামওয়ান উইথ ডার্ক স্কিন।” ছোট ছোট বাচ্চারা কোথা থেকে এই ধারণাগুলো পায়?
(৩)
দুই বছর আগে, অফিসে আমার টিমে একজন প্রার্থী নিয়োগ করতে হয়েছিল। অনেক প্রার্থীর মধ্যে একজন ছিল শিক্ষা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতায় সবার থেকে স্বতন্ত্র, সবার ঊর্ধ্বে। সে অনুসারে তাকেই চাকরিটা প্রদান করা হয়।
আমার অধীনে তাঁর চাকরি হলেও দেখলাম সব দিক থেকে সে আমার থেকে অভিজ্ঞ এবং পারদর্শী। সে ছিল নাইজেরিয়ান মধ্যবয়সী কালো একজন ভদ্রলোক। অনেক বড় বড় কোম্পানিতে বড় পজিশনে চাকরি করার পর এখন একটু পরিবারের দিকে মনোযোগ দিতে চায় বলেই কিছুটা পদাবনতি মেনে নিয়ে এই চাকরিটা সে শুরু করে।
আমি প্রথমে তাঁকে দিয়ে কাজ করানোর ব্যাপারে একটু অস্বস্তি বোধ করলেও তাঁর অমায়িক ব্যবহার, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং কাজের প্রতি একনিষ্ঠতার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই জড়তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলাম।
এরপর সে আমার সবচেয়ে আস্থাভাজন সহকর্মীতে পরিণত হয়। তবে কাজের সম্পর্কের বাইরেও আমরা ভালো বন্ধু ছিলাম।
চার সন্তানের এই বাবার বড় এবং ছোট দুই সন্তানই মানসিক এবং শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। তাদের কাজে সে অনেক ব্যস্ত থাকে। আমার বড় ছেলে আর তাঁর মেজ মেয়ে আবার একই বয়সী। দুজনের বয়সই ষোল।
খেয়াল করলাম এই মেয়ের পড়াশুনার ব্যাপারে সে ভীষণ রকমের কড়া। মেয়েকে সে ডাক্তার বানাবে। তার তোড়জোড় এখন থেকেই পুরোদমে শুরু করে দিয়েছে। আমি একবার মজা করে বলেছিলাম, “আহারে, ছোট্ট মেয়েটাকে দিয়ে আর কত কী করাবে? একটু তো ছাড় দিতে পারো।”
জবাবে সে বলেছিলো, “শী ইজ অ্যা ব্ল্যাক গার্ল। লাইফ উইল বি ভেরি টাফ ফর হার। তার জীবনে একটু ভুল, একটু এদিক-ওদিক হওয়ার উপায় নাই। সবার থেকে ভালো করতে পারলেই সে সামনে আগাতে পারবে।”
আমি সেই বাবার চোখে দেখেছিলাম একধরনের অসহায়ত্ব। দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
(৪)
বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদে সারা পৃথিবী আজ তোলপাড়। তাই হঠাৎ করেই এই নিরবচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো, স্মৃতিগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
গায়ের রং নিয়ে এই ভেদাভেদ চলে এসেছে যুগ যুগান্ত ধরে, আজ তা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” জাতীয় মুভমেন্ট প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য একান্ত প্রয়োজন।
কিন্তু শুধু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে না, গায়ের রং নিয়ে এই ভেদাভেদ আমাদের মনের শিরায় উপশিরায় প্রবাহিত। হয়তোবা আমাদের নিজের অজান্তেই।
“ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” জাতীয় মুভমেন্টের ব্যাপারে আমরা না হয় সহমর্মী। কিন্তু আমাদের নিজেদের মনের আনাচে-কানাচে যুগ যুগান্ত ধরে পুষে রাখা বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে নিজেরা কিছু না করলে, আদৌ কি এর কোনো শেষ আছে?
©আমিনা তাবাস্সুম
(২০২০ সালের “ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার্স” মুভমেন্টের সময়কার একটি লেখা)
© আমিনা তাবাস্সুম