নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য প্রখ্যাত ইংল্যান্ডের কর্নওয়াল আমাদের খুবই প্রিয় হলিডে ডেস্টিনেশন। ইংল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করার কারণে আমাদের বেশ কয়েকবার সেখানে বেড়াতে যাওয়া হয়েছে। সমুদ্র সৈকত আর প্রাকৃতিক জলাভূমি পরিপূর্ণ এই উপদ্বীপ ইংল্যান্ডের সবচেয়ে দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্ত। এর পশ্চিমে সেল্টিক সাগর, দক্ষিণে ইংলিশ চ্যানেল, আর পূর্বে টেমার নদী। কর্নওয়ালের সমুদ্র সৈকত চকচকে বালি আর নীলাভ টলটলে পানির জন্য মূলত খ্যাত হলেও, বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা তিনশোর বেশি সৈকতের একটি আরেকটি থেকে ভিন্ন আর বৈচিত্রময়। এই গ্রীষ্মের ছুটিতেও ছেলে মেয়ে নিয়ে আমাদের চারজনের পরিবার কর্নওয়ালে ঘুরে আসলাম।
আমাদের এবারের পাঁচদিনের হলিডের ঘাটি ছিল ফ্যালম্যাথ নামের এক ছোট্ট শহর। আমাদের ঘাঁটি থেকে পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই তিনটা সমুদ্র সৈকত (গিলিঙভেজ, মায়েনপর্থ, সোয়ানপুল)। যদিও এগুলো কর্নওয়ালের নামকরা সমুদ্র সৈকত গুলোর মধ্যে পড়েনা কিন্তু আমাদের এবারের পরিকল্পনা হলো সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করা আর ঘরে বসে আয়েশ করা। তাই বেশিরভাগ সময়ই আমরা কাছের এই তিনটা সমুদ্রের তীরে বসেই কাটিয়ে দিয়েছি। তবে কর্নওয়ালে গিয়ে একটা জায়গায় বেড়ানো আমরা কখনও বাদ দেইনা। জায়গাটি হলো মাইনাক থিয়েটার।
মাইনাক থিয়েটার পৃথিবীর এক অন্যতম দর্শনীয় উন্মুক্ত থিয়েটার। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে উঠে যাওয়া গ্রানাইটের পাথর খোদাই করে তৈরী করা আঁকাবাঁকা পথ আর বাগানের মাঝখানে এই থিয়েটার। খাঁজকাটা পাথরের ধাপে ধাপে বসার জায়গা, মাঝের খোলা চত্বর থিয়েটারের মঞ্চ আর দৃশ্যপটে খোলা আকাশ আর খোলা সমুদ্র যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে।
কর্নওয়ালের পর্থকারনো শহরে অবস্থিত এই থিয়েটারের উদ্ভাবক রোয়েনা কেইড নামের এক যুবতী। রোয়েনার জন্ম যার জন্ম ১৮৯৩ সালে। ১৯২০ এর দশকে রোয়েনা আর তার মা কর্নওয়ালের এই মাইনাক পয়েন্ট (প্রস্তরময় প্রান্ত) খুঁজে পেয়ে জায়গাটা কিনে ফেলে মাত্র একশত পাউন্ডে। মঞ্চ নাটক প্রেমিক রোয়েনা সেসময় স্থানীয় এক যাত্রাদলের খোলা মাঠে পরিবেশনা শেক্সপিয়ারের “এ মিডসামার নাইট’স ড্রিম” দেখে বিমুগ্ধ হয়ে যায়। সেই মুগ্ধতার বশে রোয়েনা সেই যাত্রাদলের পরের বছরের প্রোডাকশন “দ্য টেম্পেস্ট” এর স্থায়ী মঞ্চ হিসেবে তার নিজের এই মাইনাক পয়েন্টের বাগানটাকেই ব্যবহার করার জন্য প্রস্তাব দিয়ে ফেলে। কিন্তু রোয়েনার সেই বাগান তো আর সেসময় মঞ্চনাটকের জন্য উপযুক্ত ছিলোনা। তাই এরপর ছয় মাস ধরে (১৯৩১ – ১৯৩২) চলে বাগানের কাজ। রোয়েনা আর তার মালী বিলি রাউলিংস মিলে নিজ হাতে তৈরি করে এই উন্মুক্ত থিয়েটার। এরপর ১৯৩২ সালের গ্রীষ্মে মাইনাক পয়েন্টের সেই উন্মুক্ত থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় শেক্সপিয়ারের “দ্য টেম্পেস্ট”। মাইনাক থিয়েটারের সেই প্রথম পরিবেশনাই চারিদিকে বিপুল সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। রোয়েনা তার পরবর্তী জীবনকাল এই থিয়েটারের উন্নয়নে নিয়োজিত ছিলেন। সারাটা শীতকাল ধরে বাগানের কাজ চলতো অবিশ্রান্তভাবে। আর গ্রীষ্মের সময়টায় মঞ্চস্থ হতো বিভিন্ন নাটক।
সেই মাইনাক থিয়েটার এখন পৃথিবী বিখ্যাত। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে দেশ বিদেশের বিভিন্ন নামকরা ও ছোটোখাটো নাট্যদলের পরিবেশনা। আর ট্যুরিস্টদের বেড়ানোর জন্য তো খোলা থাকে সারাটা বছরই। এখন বছরে প্রায় আশি হাজার থিয়েটার দর্শক আর একশো হাজারের উপরে টুরিস্ট হয় শুধু জায়গাটা ঘুরে দেখার জন্যই।
আমার আগেও এই মনোমুগ্ধকর থিয়েটারে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে, মঞ্চ নাটক দেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু এই থিয়েটারের আকর্ষণ এমনই যে বার বার দেখলেও যেন মন ভরেনা। তাই এবারেও না গিয়ে পারলামনা। এবারে দেখলাম রাশিয়ায় প্রখ্যাত নাট্যকার আর ঔপন্যাসিক নিকোলাই গোগোলের ব্যঙ্গাত্মক নাটক “দ্য গভর্নমেন্ট ইন্সপেক্টর”। উনবিংশ শতাব্দীর (১৮৩০) রাশিয়ার এক ছোট্ট শহরের মেয়র এবং অন্যান্য সরকারী কর্মকর্তাদের দুর্নীতির রম্য কাহিনী এই একবিংশ শতাব্দীতেও (২০১৯) দেখলাম একইভাবে প্রযোজ্য, বিশেষকরে আমাদের বাংলাদেশে। যাই হোক, আমার এই লেখার উদ্দেশ্য দেশ ও জাতির চরিত্র বিশ্লেষণ না, আমার এই লেখা শুধুই মাইনাক থিয়েটার আর এখানে আমার বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে।
এখানে এসে আমি বুঝলাম যে সৌন্দর্য আর পরিবেশের প্রভাব কত প্রকট হতে পারে। আমি মোটেও গভীর মনের মানুষ না। নতুন কিছু জানা বা দেখা সম্পর্কে আমার জ্ঞানপিপাসা আর কৌতূহল দুইটাই খুবই কম। কোনো মিউজিয়াম দেখতে গেলে সেখানে সাজানো শিল্পকর্মের (আর্টিফ্যাক্ট) সামনে ইতিহাস লেখা ছোট প্ল্যাকার্ডটা পড়ার কথা মনে করলেই আমার রীতিমতো কান্না আসে। সেই আমিই যেন এই মাইনাক পয়েন্টে এসে সবকিছু প্রবলভাবে উপলব্ধি করছি, তা এই জায়গার ইতিহাসই হোক বা নাটকের বিষয়বস্তুই হোক। প্রত্যেকটা অনুভুতি যেন মনে হলো এর থিয়েটারের দৃশ্যপটের আকাশের বিশালতা থেকেও বিশাল, সমুদ্রের গভীরতা থেকেও গভীর। আর কিছু না হোক শুধু ছোটোখাটো অনুভুতি গুলোকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার জন্য হলেও এখানে বার বার আসা সার্থক।
© আমিনা তাবাস্সুম