Ameena Tabassum

কেমব্রিজ সেন্ট্রাল মসজিদ

পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক মসজিদই সৌন্দর্য এবং অনন্য ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন হিসেবে প্রখ্যাত। রাজকীয় গম্বুজ, ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি, জ্যামিতিক নকশা আর সূক্ষ্ম কারুকাজ শোভিত মসজিদগুলো শুধু নামাজ পড়ার স্থানই না, এই স্থাপনাগুলো ইসলামিক সভ্যতা ও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সারা যুক্তরাজ্য জুড়েও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক মসজিদ। তবে স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে যুক্তরাজ্যের মসজিদগুলো যেন কিছুটা পিছিয়ে আছে।

আমি ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। আর প্রার্থনার জায়গা ভ্রমণের ব্যাপারে আমার বিশেষ আগ্রহ। বিশেষ করে মসজিদ দেখলে অজানা কারণে আমার মনটা ছুটে যায়। কথায় আছে যে সৃষ্টিকর্তা তো সব জায়গায়ই বিরাজমান। সৃষ্টিকর্তার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে হলে হৃদয়টাই আসল। আর কিছু লাগে না। কিন্তু এই হৃদয় বা মন বড়ই অদ্ভুত জিনিস। একেক পরিবেশ, একেক আবহে এই মনটা একেক রূপ ধারণ করে। সেই একেক রূপের উপর অনেকসময় নিজেরই নিয়ন্ত্রণ থাকেনা অথবা নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল জানা থাকেনা। নাকি নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছাটাই থাকেনা। সে যাই হোক, আমার কাছে মসজিদ সৃষ্টিকর্তার সাথে সংযোগ স্থাপনের এক পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার নিমিত্ত। তাই মসজিদ আমাকে টানে।

আমরা ইংল্যান্ডের বাসিন্দা। গত সামারে পরিবারের সাথে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মূল উদ্দেশ্য ছিল কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি পরিদর্শন। কিন্তু ইউনিভার্সিটি পরিদর্শনের সাথে সাথে ২০১৯ সালে তৈরি বিখ্যাত কেমব্রিজ সেন্ট্রাল মসজিদ পরিদর্শনের সুযোগটাও হাতছাড়া করিনি। কেমব্রিজ সেন্ট্রাল মসজিদ ইউরোপের সর্বপ্রথম মসজিদ যেটা পরিবেশবান্ধব (eco-friendly) উপায়ে নির্মিত।

২০০৮ সালে মসজিদটি নির্মাণের প্রথম উদ্যেগ নেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক ডক্টর টিমোথি উইন্টার। ডক্টর উইন্টার কেমব্রিজের মুসলিমদের কাছে আব্দাল হাকিম মুরাদ নামেও পরিচিত। এরপর ২০০৯ সালে মসজিদের জন্য এক একর জমি কেনা হয়। এই জমি কিনতে খরচ পড়েছিল চার মিলিয়ন পাউন্ড। সেই বছরই মসজিদের নকশার দায়িত্ব লন্ডনের প্রখ্যাত স্থাপত্যশিল্পী মার্ক বারফিল্ডকে দেওয়া হয়। মার্ক বারফিল্ড অনেক নামকরা স্থাপত্যের কাজ করেছে। এর মধ্যে লন্ডন আই এবং কিউ গার্ডেনের ট্রি টপ ওয়াক হয়তোবা অনেকের কাছেই পরিচিত। এই প্রজেক্টে আরো কাজ করেন স্থাপত্যশিল্পী এবং ইসলামিক জ্যামিতিক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর কিথ ক্রিচলো আর সাথে ছিলেন প্রখ্যাত গার্ডেন ডিজাইনার এমা ক্লার্ক।

এরপর প্রায় আট বছরের গবেষণা এবং তহবিল সংগ্রহ শেষে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এই মসজিদের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তহবিল সংগ্রহ করা হলেও, দুই–তৃতীয়াংশ অর্থই নাকি এসেছে তুরস্ক থেকে। তাই ২০১৯ সালের মার্চ মাসে মসজিদের কাজ শেষ হলে মসজিদটি উদ্বোধন করেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী।

টেকসই অথবা Sustainable-design এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণ এই স্থাপত্যের একটা বিশাল আকর্ষণ। দিনের বেলায় প্রাকৃতিকভাবে যেই আলো আসে সেটাই মসজিদের জন্য যথেষ্ট। আর প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় সোলার প্যানেলের সাহায্যে। এছাড়াও মসজিদের ছাদে বৃষ্টির পানি প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা আছে। যার জন্য গরমেও মসজিদের ভিতর একধরণের ঠান্ডা আবহ তৈরি হয়।

তবে সৌন্দর্যের দিক থেকেও মসজিদটি কোনো অংশে কম না। পরিবেশসম্মতভাবে তৈরি করার জন্য মসজিদের ভিতরে ইটের পিলারের পরিবর্তে গাছের কলাম ব্যবহার করা হয়েছে। যা মসজিদের ভিতরে এক ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যুক্ত করেছে। সম্পূর্ণ মসজিদের নকশা জ্যামিতিক কারুকাজ এবং ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি শোভিত। এই অভিনব নকশা ইসলামিক এবং ইংরেজি স্থাপত্যর অপূর্ব সমন্বয়ের নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। আর মসজিদের সামনের বাগানটা তো সত্যিকার অর্থে যেন এক শান্ত মরুদ্যান। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে রয়াল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস (RIBA) এই মসজিদ ট্রাস্টকে এর অসামান্য সৃজনশীল স্থাপত্যের জন্য “ক্লায়েন্ট অফ দ্য ইয়ার ২০২১” এর বিজয়ী হিসাবে ঘোষণা করেছে।

আমরা এক শনিবারে সকাল সকাল সেই মসজিদ পরিদর্শনের জন্য হাজির হয়েছিলাম। সেইসময় কোনো জামাতের সময় ছিল না তাই তুলনামূলকভাবে লোক সমাগম কিছুটা কম ছিল। আগেই বলেছি, যে মসজিদ আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। ইংল্যান্ডের ছোটোখাটো কোন জরাজীর্ণ মসজিদের ভিতরে পা রাখলেই আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। আর এই মসজিদ তো যেন স্বর্গের উদ্যান।

মেয়েদের নামাজ পড়ার জন্য বিশাল অজুর জায়গা সহকারে আলাদা একটা নামাজের হলঘর আছে। সেখানে গিয়ে দুইরাকাত নফল নামাজ আদায় করে নিলাম। সেখান থেকে মূল নামাজের হলে এসে দেখি সেখানেও পুরুষ এবং নারী উভয়েরই নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। এই বিশাল হলঘরেই সারি সারি গাছের কলাম বসানো, ছাদটা কী অপূর্ব জ্যামিতিক ডিজাইন। এই ঘরে এসে নামাজ না পড়লে আমার মনেহলো যেন জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে। এই ঘরে এসে আমি এত আবেগী হয়ে পড়েছিলাম যে আমার মনে হচ্ছিলো এই মসজিদের এক কোনায় আমাকে ছোট্ট একটা জায়গা দিলে আমি সারাজীবন এখানে কাটিয়ে দিতে পারবো। জীবনে যেন আর চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই।

কিন্তু এইসব সব আবেগের অনুভূতি। এই অনুভূতি বড়ই ক্ষণস্থায়ী। মুহূর্তের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে একান্তে নিজের আবেগ প্রকাশ করেই আবার বাস্তবে ফিরে আসি। ইহলৌকিক মায়ায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাই। শুরু হয়ে যায় ছবি তোলা, ফেসবুকের পোস্ট, ঘরে ফেরার তাড়া, সংসারের কাজের সব ফিরিস্তি। শুরুতে নিজেকে বড়ই অপরাধী মনেহয়, নিজেকে বড়ই পাপী মনেহয়। তারপর সেই অনুভূতিও ফিকে হয়ে আসে। একেবারেই ডুবে যাই এই ইহজগতের মায়ার খেলায়। কিন্তু তারপরও মাঝে মাঝে ঠিকই উঁকি দেয় সেই অনুভূতিগুলো। মন ছুটে যায় সেই স্বর্গের উদ্যানে। যেখানে একটুকরো জায়গা পেলেই যেন কিছুটা স্বস্তি মিলবে। এছাড়া জীবনে যেন কোনো স্বস্তি নেই।

© আমিনা তাবাস্সুম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top