Ameena Tabassum

কুন্তা কিন্তে দ্বীপ

সেদিন গাম্বিয়া নদীর মোহনা ছিল উত্তাল। কতটা উত্তাল, সেই সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। কিছু না জেনেই অতি উৎসাহের সঙ্গে একটা কাঠের ছোটখাটো নৌকায় আমরা চেপে বসেছিলাম। আমাদের পরিবারের চারজন, সঙ্গে আমাদের ড্রাইভার সুলেমান আর টুরিস্ট গাইড। নৌকায় ছিল নৌকার মাঝি এবং তার একজন সহকারী।

আমাদের গন্তব্যস্থল কুন্তা কিন্তে দ্বীপ, যার নাম আগে ছিল জেমস আইল্যান্ড। আলেক্স হ্যালির রুটস বইয়ের মাধ্যমে সারা বিশ্ব এই কুন্তা কিন্তে নামের সাথে পরিচিত হয়। গাম্বিয়া যাবার আগে দেশটি সম্পর্কে বিশেষ কোনো ধারণা না থাকলেও এই কুন্তা কিন্তে দ্বীপ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নিয়েই গিয়েছিলাম। গাম্বিয়া নদীর মোহনা থেকে এই দ্বীপ প্রায় ৩০ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত। সতেরো শতকে ব্রিটিশরা প্রথম সেখানে তাদের ঘাঁটি নির্মাণ করে। এরপর ব্রিটিশসহ একে একে আরও ইউরোপীয় শক্তির নিয়ন্ত্রণে সেসময়ের দাস ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে ওঠে এই দ্বীপ।

গাম্বিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে শত শত পুরুষ, নারী ও শিশুকে ধরে এনে ইউরোপ এবং আমেরিকায় চালান করার আগে রাখা হতো এই দ্বীপে। সাধারণত দাস বানানোর জন্য আনা হতো শক্ত-সমর্থ মানুষদের। কখনো বন্দুক দেখিয়ে বা ভয় দেখিয়ে তাদের ধরা হতো। কখনো কিছুই করা লাগত না। ইউরোপ এবং আমেরিকার সাদারা গাম্বিয়া নদীর মোহনায় এসে মদ, চিনি, কাপড়, তামাক, লোহা—এসব দ্রব্যাদি বিক্রি করত। আর গাম্বিয়ার মানুষরাই অন্যদের ধরে এনে দাস হিসেবে বিক্রি করে বিনিময়ে তাদের পছন্দের কোনো দ্রব্য কিনে নিত। তারপর এই ক্রীতদাসদের ইউরোপ বা আমেরিকায় এনে নানান কাজে লাগানো হতো। তবে একটা বড় অংশকে দিয়ে আবার এসব দ্রব্যাদি উৎপাদনের কাজই করানো হতো। তাদের উৎপাদিত দ্রব্যাদি নিজেদের দেশের চাহিদা মিটিয়ে আবার জাহাজে করে গাম্বিয়ার মোহনায় এনে আরও দাস কিনে নিয়ে যাওয়া হতো। এ কারণেই এই পুরো ব্যাপারটিকে The Triangular Trade বলা হতো। বলা হয়, ১৮ এবং ১৯ শতকের ইন্ডাস্ট্রিয়ালিজমের মূল ভিত্তি স্থাপনই হয় এই Triangular Trade-এর মাধ্যমে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই দাসদের সরাসরি জাহাজে করে পাচার না করে কেন এই জেমস আইল্যান্ডে রাখা হতো? প্রথমত, একবারে জাহাজ বোঝাই করার মতো দাস জোগাড় হত না। তাই অল্প অল্প করে মানুষ ধরে নৌকা করে এই দ্বীপে এনে জড়ো করা হতো। এছাড়া, শক্ত-সমর্থ এতজন মানুষকে জাহাজে করে এত দীর্ঘ যাত্রা করানো সহজ ছিল না। তাই মানুষগুলোকে এই দ্বীপে এনে তাদের উপর পাশবিক এবং অমানবিক অত্যাচার করা হতো। তাদের সব শক্তি নিঃশেষ করে, ক্ষুধার্ত, দুর্বল, মুমূর্ষু করে ফেলা হতো। কোনো রকমে জানটা টিকে থাকবে এমন অবস্থায় এনে তারপর জাহাজে করে চালান করা হতো। যাতে জাহাজ বোঝাই এতগুলো মানুষের সামান্যতম প্রতিবাদ করার ক্ষমতা বা শক্তি না থাকে।

এই দ্বীপে সবাইকে শিকল পরিয়ে ট্রেঞ্চের মধ্যে রাখা হতো। পুরুষদের একদিকে এবং নারী ও শিশুদের আরেকদিকে। সেই ট্রেঞ্চের মধ্যেই চলতো মল-মূত্র ত্যাগ, ঘুমানো এবং খাওয়া-দাওয়া। খাওয়া বলতে, অনাহারে জানটা যাতে বেরিয়ে না যায়, সেই টুকু খাবারের ব্যবস্থা। যারা একটু বেশি শক্তিশালী বা বিদ্রোহী ছিল, তাদের আলাদা করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হতো। আর নারী ও শিশুদের যৌন দাস-দাসী হিসেবে ব্যবহার করা হতো প্রায়শই।

চারদিকে কামান, বন্দুকসহ গার্ড দ্বারা ঘেরা এই দ্বীপে শিকলে বাঁধা মানুষগুলোর পালানোর কোনো উপায় ছিল না। তারপরও কেউ না কেউ প্রতিদিন কেমন করে যেন নদীতে ঝাঁপ দিত। শিকলে বাঁধা এই মানুষগুলোর উত্তাল নদী পেরিয়ে গাম্বিয়ার মোহনায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা ছিল প্রায় শূন্য। তারপরও নদীর গভীরে চিরতরে হারিয়ে গিয়েই যেন তারা বেঁচে যেত। তবে শুধু নদীতে ঝাঁপ দিয়েই নয়, অনাহার, কলেরা আর ম্যালেরিয়ায়ও প্রতিদিন অনেক মানুষ মারা যেত। তাদের মৃতদেহগুলোও নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার জন্য জাহাজে তোলার আগেও শেষবারের মতো আরেকবার যাচাই-বাছাই করা হতো। যারা অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে পড়ত এবং এই যাত্রায় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তাদেরকেও পানিতে ফেলে দেওয়া হতো। বাকিদের শিকলে বেঁধে জাহাজ বোঝাই করা হতো। আর জেমস আইল্যান্ড আবার ভরে উঠত নতুন করে ধরে আনা দাসদের দিয়ে।

এরকমই একজন গাম্বিয়ান ক্রীতদাস ছিলেন আলেক্স হ্যালির পূর্বপুরুষ রুটস বইয়ের কুন্তা কিন্তে। তার সম্মানে ২০১১ সালে দ্বীপটির নাম জেমস আইল্যান্ড থেকে বদলে কুন্তা কিন্তে নাম দেওয়া হয়। বর্তমানে এই দ্বীপটি ট্রান্সআটলান্টিক দাস ব্যবসার এক মর্মান্তিক প্রতীক হিসেবে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।

উত্তাল নদীতে আমাদের এই দ্বীপের পথে যাত্রাটাও সহজ ছিল না। আমরা যেহেতু আমাদের ড্রাইভার সুলেমান আর গাইডের উপর সব ছেড়ে দিয়ে বসে ছিলাম, নদীর যে এই অবস্থা হতে পারে, সেটা আমাদের মাথায়ই আসেনি। কিন্তু টের পেলাম যাত্রা শুরুর পর। একেকটা ঢেউ যেন নৌকা থেকে বেশ কয়েক ফুট উপরে উঠে যাচ্ছে, আর মনে হচ্ছে এই বুঝি আমরা নদীর গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। আমরা ভেবেছিলাম বাকিরা বলবে, চিন্তার কোনো কারণ নেই। নদী এরকমই থাকে, আর সবাই এর মধ্যেই দ্বীপ দেখতে যায়। কিন্তু আমাদের হতাশ করে সুলেমান বলে উঠল যে জীবনে বহুবার সে এই নদীতে যাত্রা করেছে, কিন্তু এরকম উত্তাল নদী কোনোদিন দেখেনি। সাথে সাথে আগুনে ঘৃতাহুতি দিতে গাইড বলে উঠল, “এ কারণেই দেখছো না, আজকে কোনো টুরিস্ট নেই। নদীর এই অবস্থা দেখে সব বোট ট্রিপ ক্যানসেল।” ইতিমধ্যে আমরা মাঝ নদীতে। এরকম কথা সেসময় শুনলে মেজাজটা কেমন হয়? এই কথাটা আমাদের আগে জানানো দরকার ছিল না?

তবে আমাদের মাঝি আর তার সহকারী ভীষণই দক্ষ ছিল। ঢেউয়ের সাগর কেমন দক্ষ হাতে পাড়ি দিতে হয়, তা তারা ভালোভাবেই জানত। অবশেষে আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে পৌঁছে গেলাম সেই কুন্তা কিন্তে দ্বীপে।

উত্তাল নদীর মাঝখানে অর্ধেক ক্ষয়ে যাওয়া এই দ্বীপের প্রাচীন ফোর্ট জেমস-এর ধ্বংসাবশেষ আজও নীরবে সেখানকার অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতা, ভয়াবহ যন্ত্রণার ভয়ঙ্কর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা একজন কুন্তা কিন্তের গল্প জানি। এমন হাজারো, এমনকি লক্ষ কুন্তা কিন্তে ছিল, যাদের গল্প হারিয়ে গেছে, যাদের নাম মুছে গেছে, যাদের সংগ্রাম আমাদের অজানা। আমাদের সামান্য উত্তাল নদীর যাত্রার ভয়াবহতা এই ইতিহাসের নিষ্ঠুরতার কাছে এতই তুচ্ছ যে সেই দ্বীপে পৌঁছে আমরা আমাদের যাত্রার কথা ভুলেই গেলাম।

১৫ শতক থেকে কয়েক শত বছর ধরে এই দাস প্রথার অমানবিকতা চলতে থাকে। এই দাস প্রথার প্রধান এবং অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ব্রিটিশরা দয়াপরবশ হয়ে অবশেষে ১৮০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দাস প্রথা বিলুপ্ত করে। কিন্তু আমেরিকা এবং অন্যান্য আরও দেশে এই প্রথা চলে আরও অনেক বছর।

সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মহাদেশের শক্তিশালী সব মানুষদের জোরপূর্বক ধরে বেঁধে দাস বানিয়ে এনে যুগ যুগ ধরে তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার এই ব্যাপারটা আমার কাছে ভীষণ বিস্ময়কর মনে হলো। ধরলাম, যারা এই কাজগুলো করেছে, তাদের অনেক বুদ্ধি ছিল। ধরলাম, যাদেরকে দাস বানানো হয়েছে, তাদের নিজেদের মানুষরাই সাহায্য করেছে। ধরলাম, জোর যার মুলুক তার। কিন্তু যেই মানুষগুলো বুদ্ধি এবং যুক্তি খাটিয়ে এই অমানবিক কাজ করার পরিকল্পনা করেছে এবং যুগ যুগ ধরে সফলতার সাথে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে, তাদেরকে আর যাই বলা যায়, মানুষ কি বলা যায়?

দাস প্রথা হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু পৃথিবী জুড়ে অত্যাচার, অনাচার, নিষ্ঠুরতার বিলুপ্তি হয়নি। মানুষ ঠিক একই রকম রয়ে গেছে। পৃথিবী জুড়ে নানান নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে নিচ্ছে।

এই যে আজ সবার চোখের সামনে প্যালেস্টাইন দেশটাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে মেরে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। একদিন সেই মর্মান্তিক সব গল্প লেখা হবে। যারাই এই ধ্বংসযজ্ঞ এবং অমানবিকতার মদত জুগিয়েছে, তারাই ইতিহাস লিখবে। এই ধরনের গর্হিত অপরাধের ছিছিক্কার করবে। আর তাদের মহানুভবতায় সারা পৃথিবীর মানুষ কৃতার্থ হবে।

কিন্তু তারপর আবার হবে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি… এটাই চরমতম সত্য।

© আমিনা তাবাস্সুম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top