আমি খেয়াল করেছি যে আমি শুধু ইন্টেলিজেন্ট পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট হই। পুরুষদের চেহারা, উচ্চতা, গড়ন, গায়ের রং, চাকরি, যোগ্যতা, অর্থ কিছুতেই আমার কিছু আসে যায়না। কিন্তু কোনো ইন্টেলিজেন্ট পুরুষ দেখলে আমার একেবারে মাথা খারাপ হয়ে যায়।
আমার এই মুহূর্তে সেই রকম “মাথা খারাপ” অবস্থা। আমি আমার ইউনিভার্সিটির পার্সোনাল টিউটরের সামনে বসে আছি। আমার এই টিউটরের নাম ডক্টর গ্রীন। নামকরা এক ম্যাথমেটিশিয়ান সে। তার অফিস কক্ষে মুখোমুখি বসে আমার ডিসার্টেশন (dissertation) নিয়ে আলোচনা করছিলাম। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর কথায় খুব একটা মন দিতে পারছিনা। আমার হাত ঘামছে, বুক দুরুদুরু, পা কাঁপছে।
আমি ইংল্যান্ডের এক ইউনিভার্সিটির অনার্সের শেষ বর্ষের ছাত্রী। ম্যাথস নিয়ে পড়াশুনা করছি। শুধুমাত্র ডক্টর গ্রীনের লেকচার পাবার জন্য আমি “হিস্ট্রি অফ ম্যাথমেটিক্স” কোর্সটা এইবার নিয়েছি। এছাড়া এই বোরিং কোর্স নেবার কোনো কারণ নেই। আর শুধু তাঁর জন্যই আমার ফাইনাল ডিসার্টেশন ম্যাথমেটিক্সের ইতিহাসের উপর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সে তো এতে মহাখুশি। খুব কম ছাত্র ছাত্রীই এই ম্যাথসের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছে। আর এই কাজের সুবাদে আমার আজকাল ঘনঘন তাঁর কক্ষে নিভৃতে সাক্ষাতের সুযোগ হয়ে যাচ্ছে। এমনিতে অবশ্য গত তিনবছর ধরে নিয়মিত তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। আমার পুরো কোর্স চলাকালীন সময়ে সে আমার পার্সোনাল টিউটর ছিল। সেই সুবাদে আরো কিছু ছাত্র ছাত্রীর সাথে ডক্টর গ্রীন আমারও পড়াশুনার নিয়মিত তদারকি করেছে। কিন্তু অনার্সের কোর্স প্রায় শেষ হয়ে আসছে। ইউনিভার্সিটির শেষের দিনগুলোতে তার আরেকটু সান্নিধ্য পাবার আশায় এই কোর্সটা নেওয়া। ডেসপারেট টাইমস কল ফর ডেসপারেট মেজারস। আমার এই ডিসার্টেশন এখন সেই ডেসপারেট মেজার।
ডক্টর গ্রীনের বয়স মনেহয় পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে হবে। মাথা ভর্তি কাঁচা পাকা চুলের কারণে আরেকটু বেশি দেখায়। অতিরিক্ত ফ্যাটফেটে সাদা আর পাঁচ দশের মতো হাইট হবে হয়তো। কিন্তু কিছুটা কুঁজো হয়ে চলার কারণে তাকে আরো খাটো দেখায়। সবসময় খুবই অগোছালো হয়ে থাকে সে। নিজের চেহারা বা পোশাক আশাকে অযত্নের ছাপ সুস্পষ্ট। কেউ হঠাৎ করে দেখলে সবকিছু মিলিয়ে তাকে কুৎসিত মনে করতে পারে। কিন্তু আমার কাছে তা মোটেও মনে হয়না। আমার মনে হয় রূপে না গুনে তাঁর পরিচয়। ডক্টর গ্রীনের সাথে কিছুক্ষন কথা বললে, তাঁর জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে অবগত হলে, তাঁর প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে কেউ পারবেই না। ইউনিভার্সিটির গত তিনটা বছর ধরে তো আমি দিন রাত তাকে নিয়ে কল্পনা করেছি। তবে মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে যে এই ধরণের আকর্ষণের কোনো মানে আছে?
যা হোক, আমার সব পরীক্ষা শেষ, আর আজকে ডিসার্টেশনের ফাইনাল প্রুফ দেখাতে এসেছি। সব ঠিক থাকলে আজকেই কাজটা সাবমিট করে দিবো। তারপর সব শেষ। জীবনে কি আর ডক্টর গ্রীনের সাথে কখনো দেখা হবে? এই মনে করে আমার মনটা যে আজ কী খারাপ তা আমি বলে বুঝাতে পারবোনা।
আমার ডিসার্টেশনের টপিক হলো “লুকাসিয়ান প্রফেসর অফ ম্যাথমেটিক্স”। ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজের এই বিশ্ববিখ্যাত প্রফেসর পোস্ট হাতেগুনে কয়েকজন বিখ্যাত ম্যাথমেটিশিয়ানকে দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে আইজ্যাক নিউটন আর স্টিফেন হকিংস আছে। আমি এই প্রফেসরদের উপর সব ধরণের তথ্য সংগ্রহ করে উপস্থাপন করেছি। জীবনে মনেহয় আর কোন কিছুর জন্য এত সময় আর শ্রম দেইনি। শুধুমাত্র ডক্টর গ্রীনকে একটু খুশি করার জন্য। ডক্টর গ্রীন আমার কাজে রীতিমতো মুগ্ধ। তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। সেই জ্বলজ্বলে চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– বাহ্! এই প্রফেসরদের নিয়ে আমিও অনেক কাজ করেছি কিন্তু কিছু তথ্য আমারও জানা ছিলোনা। ওয়েল ডান। আমার মনেহয় তুমি ফাটাফাটি নাম্বার পাবে।
ধুর, নাম্বার নিয়ে আমি মোটেও ভাবিত না। ডক্টর গ্রীনের এই জ্বলজ্বলে দৃষ্টির কাছে সব নাম্বার আমার কাছে তুচ্ছ। তার এই চোখের দিকে তাকিয়ে আমি সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। কিন্তু সারাজীবন তো দূরের কথা, এই চোখের দিকে আর অল্পকিছুক্ষন তাকিয়ে থাকারও সুযোগ আমার হলোনা।
ডক্টর গ্রীন আমাকে গুড উইশেস জানিয়ে বিদায় দিয়ে দিলো। আমি ব্যথিত হৃদয়ে সাথে আনা একটা থ্যাংক ইউ কার্ড আর বাংলাদেশের আড়ং থেকে কেনা একটা নকশিকাঁথার ওয়াল হ্যাংগিং তার হাতে তুলে দিলাম।
ডক্টর গ্রীন উচ্ছসিত হয়ে বলে উঠলো,
– সো জেনেরাস অফ ইউ। কোনোই দরকার ছিলোনা। কিন্তু আমার ওয়াইফ তোমার এই ওয়াল হ্যাংগিং টা খুবই পছন্দ করবে। আর তোমার চাকরি বা অন্যকোনো ব্যাপারে রেফারেন্সের প্রয়োজন হলে অবশ্যই আমার সাথে যোগাযোগ করবে। কেমন?
আমি কোনোরকমে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানিয়ে বেরিয়ে আসলাম। আমার মনে হচ্ছে আমার হাঁটার মতো কোনো এনার্জি নেই। পরীক্ষা শেষ, ডিসার্টেশন জমা দিয়ে দিলাম, এখন নিজেকে পাখির পালকের মতো হালকা মনে হবার কথা। কিন্তু পা দুটো এত ভারী লাগছে যে নিজের শরীরের বোঝা যেন নিজেই বইতে পারছিনা।
আর আজকের দিনেই আবার ফ্যামিলি থেকে ঠিক করা এক এলিজিবল ব্যাচেলর পাত্রের সাথে আমার দেখা করার কথা। আমার পরিবার আপাতত হারিকেন দিয়ে আমার জন্য পাত্র খুঁজছে। আমার মায়ের মতে আমার মতিগতি নাকি ভালোনা। যত তাড়াতাড়ি আমার বিয়ে দেওয়া হবে, ততই নাকি আমার জন্য মঙ্গল। যেই পাত্রের সাথে আমার দেখা করার কথা, সেই পাত্র ডাক্তার। মহা ব্রিলিয়ান্ট নাকি। বাংলাদেশে পড়াশুনা করা ডাক্তার কিন্তু একবারে ইংল্যান্ডের সব পরীক্ষা টরীক্ষা পাশ করে এক হসপিটালে ট্রেইনি ডক্টর হিসেবে জয়েন করেছে। সে নাকি দেখতেও ভীষণ হ্যান্ডসাম। তবে আমি জানি যে আমার মা আমাকে পটানোর জন্য এই কথা বলেছে। কিন্তু চেহারা দেখে আমি যদি পটে যেতাম তাহলে তো ভালোই হতো। বলেছিনা, আমি শুধু পুরুষ মানুষের ইন্টেলিজেন্সে আকৃষ্ট হই। আর এযাবৎকাল ডক্টর গ্রীনের চেয়ে ইন্টেলিজেন্ট আর কোনো পুরুষমানুষের সান্নিধ্য লাভ করার সুযোগ হয়নি। ডক্টর গ্রীনের কথা মনে হতেই বুকের ভিতর চাপ ব্যথা অনুভব করছি। আর ডাক্তার পাত্রের কথা মনে করে আমার আপাতত গা গুলাচ্ছে।
আমি দুইজন বান্ধবীর সাথে একটু কিছুক্ষন গল্পগুজব করে ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সন্ধ্যা ছয়টার সময় সেই ডাক্তার পাত্রের সাথে আমার ইউনিভার্সিটির অদূরেই একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করার কথা। আমি পনেরো মিনিট ধরে হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে সেই রেস্টুরেন্টে এসে পৌছালাম। একেবারে রিভার টেমসের উপর বেশ রোম্যান্টিক সেটিঙে একটা ছিমছাম রেস্টুরেন্ট। নাহ, পাত্র ভালো রেস্টুরেন্ট বাছাই করেছে, এর রুচির প্রশংসা করতেই হয়। পাত্রের নাম এহতেশাম। তবে নামটা ভীষণ খারাপ। এর সাথে যার বিয়ে হবে সেই মেয়েটার জন্য আমারই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের পর বরকে সেই মেয়ের “এহতেশাম”, “এহতেশাম” বলে ডাকতে হবে। আমার এই পাত্রের সাথে অল্প কিছু মোবাইলে টেক্সট চালাচালি হয়েছে। আজকের এই দেখা করার ব্যাপারটা ঠিকঠাক করার জন্য।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে মনেহলো আমার আরেকটু ভালো কাপড়চোপড় পরে তৈরি হয়ে আসা উচিত ছিল। আমার পরনে মলিন নীল রঙের জিন্স আর হালকা হলুদ রঙের ঢিলা সুতির টপ। চোখে শুধু কাজল আর আইলাইনার লাগানো, আর কোনো সাজসজ্জা নেই। ডক্টর গ্রীনের সাথে দেখা করার ঠিক আগেই অনেক যত্ন করে চোখে কাজল লাগিয়েছিলাম। আমি দেখতে মোটামুটি। সাদামাটা বাঙালি চেহারা আমার। তবে আমার ফিগারটা খুবই আকর্ষণীয়। ঢিলাঢালা পোশাক পরে থাকি বলে আমার ফিগার অবশ্য অন্যের পক্ষে বুঝার কোন উপায় নেই। নিজের চেহারা আর ফিগার নিয়ে হঠাৎ চিন্তা করছি কেন ঠিক বুঝলাম না। নিজের উপর একটু বিরক্ত হয়েই রেস্টুরেন্টের রিসেপশনে এসে দাঁড়ালাম। সাথেই সাথেই এহতেশাম সাহেব এসে হাজির। সেই রকম সাজ দিয়ে এসেছে সে। আমার আবারও মনে হলো, আরেকটু ভালো কাপড়চোপড় পরে আসা উচিত ছিল।
এহতেশাম আমাকে দেখে একটা নার্ভাস হাসি দিলো।
আমি তার দিকে তাকিয়ে পাল্টা আত্মবিশ্বাসের হাসি ছুড়ে দিলাম।
একটু নিরিবিলি জায়গায় আমাদের দুইজনের জন্য একটা ছোট্ট টেবিল রিসার্ভ করা আছে। সেই টেবিল থেকে সরাসরি নদী দেখা যায়। আমি চেয়ারে বসেই সাথে সাথে মেন্যু দেখা শুরু করে দিলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো খিদায় পেটটা একেবারে চোঁচোঁ করছে। আমি মনোযোগ সহকারে মেন্যু দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম এহতেশাম হাতে মেন্যু ধরে আছে ঠিকই, কিন্তু সেদিকে তার কোনো মন নেই। সে আড়চোখে আমাকে দেখার চেষ্টা করছে। তবে খুব একটা আড়চোখে যে দেখছে তা ঠিক না, মোটামুটি সোজাসাপ্টা ভাবেই দেখছে।
আমি সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
– আপনার মনেহয় মেন্যু দেখায় কোনো মন নাই?
– জি না। আমি কী কী খাবো তা অন-লাইনে মেন্যু দেখে আগেই ঠিক করে রেখেছি।
এই বলে সে একটা হাসি দিলো। হাসি দিয়ে বুঝাতে চাইলো যে দ্যাখো আমার কত বুদ্ধি। আমার মনে হলো এই যদি তার বুদ্ধির নমুনা হয় তাহলে আমার বলার কীই বা আছে। মানে মানে খাওয়া দাওয়া শেষ করে এর কাছ থেকে মুক্তি পেলেই আমি এখন বাঁচি। আমি বললাম,
– ওহ, তাহলে শুধু শুধু মেন্যু দেখার ভান করছেন কেন?
– একেবারে সোজাসুজি আপনার দিকে তাকিয়ে থাকলে ব্যাপারটা একটু অশোভন দেখাতে পারে দেখে মেন্যু দেখতে দেখতে আপনাকে দেখছিলাম।
আবারো সেই হাসি। বুঝাতে চাচ্ছে যে দেখো আমার কেমন বুদ্ধি।
– তো আমাকে কেমন দেখলেন?
এই কথাটা কেন বললাম জানিনা। এখন নিজেরই অস্বস্তি লাগছে।
সে আমার প্রশ্ন শুনে মনে হলো মহা আনন্দিত। একটা হাসি দিয়ে বললো,
– আপনি কিন্তু সুইট আছেন।
পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ মনেহয় নাই যে নিজের প্রশংসা শুনলে খুশি হয়না। আমিও হলাম কিন্তু তা প্রকাশ হতে দিলাম না। আমি একটু ভালোমতো এহতেশামকে দেখে নিলাম। আমার থেকে বয়সে সে বেশ একটু বড়ই। ডাক্তারি টাক্তারি পাশ করে, আবার এখানে এসে সব পরীক্ষা দিয়ে চাকরি শুরু করেছে। কিন্তু কোনো এক কারণে তাকে বাচ্চা বাচ্চা মনে হচ্ছে। দেখতেও খুব একটা খারাপনা। আর হয়তোবা অনেক পড়ুয়া টাইপের ছেলে। এইকারণে ভালো পড়াশুনা করে ভালো ডাক্তার হয়েছে। কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত তার কথাবার্তা বা হাবভাবে বুদ্ধিমত্তার কোনো চিহ্ন দেখছিনা। সেকারণে তার প্রতি কোনো ধরণের আকর্ষণই বোধ করছিনা।
আমি তার প্রশংসার জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না। বললাম,
– আমিও কী খাবো ঠিক করে ফেলেছি। ওয়েটার কে বলবেন একটু অর্ডারটা নিতে। আমি সারাদিন না খেয়ে আছি।
বোকা লোকটা কোথায় ওয়েটার কে ডাকবে, তা না করে জিজ্ঞেস করলো,
– না খেয়ে আছেন কেন? ডায়েটিং করেন?
– জি না। আমি এমনিতেই স্লিম। আমার ডায়েটিং করার প্রয়োজন নেই। আমি আমার ডিসার্টেশন সাবমিট করার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। খাওয়ার সময় পাইনি।
– ওহ।
– আমার ডিসার্টেশনের টপিক কী জানেন?
– নাহ, আমি কেমন করে জানবো?
– আমি কাজ করেছি গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসরদের নিয়ে। উনাদের সম্পর্কে আপনি জানেন?
এহতেশাম আমার দিকে একটা ব্ল্যাংক লুক দিলো। আমি জানতাম, এই লোক কিছুই জানেনা। ঠিক সেই সময় ওয়েটার এসে হাজির। এহতেশাম আমাকে আগে অর্ডার দেবার জন্য অনুরোধ করলো তারপর নিজের অর্ডার জানিয়ে দিলো। ওয়েটার অর্ডার দিয়ে চলে যেতেই এহতেশাম বলে উঠলো,
– এক্সকিউজ মি প্লিজ। খাবার আসার আগে আমি একটু ওয়াশরুম থেকে ঘুরে আসি।
এই বলে সে চলে গেলো। এহতেশাম উঠে যাওয়ায় ভালোই হলো। আমার এখন একটু সহজ লাগছে। আমি শান্তিমতো নদী দেখলাম, রেস্টুরেন্টের ডেকোরেশন মন দিয়ে দেখলাম, ব্যাংকগ্রাউন্ডে জন লেজেন্ডের “অল অফ মি” গান বাজছে, সেটা মন দিয়ে কিছুক্ষন শুনলাম। তারপর কিছুক্ষন ফেসবুক গুতাগুতি করলাম। খুব কায়দা করে নদীর ভিউ সহকারে রেস্টুরেন্টের একটা ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে দিলাম। খাবারের ছবি তুলে পোস্ট দিলে ভালো হতো কিন্তু এহতেশামের সামনে ছবি তুলতে চাইনা আমি। পোস্টে লিখে দিলাম,
– Exam done, Dissertation done, Time to relax
এভাবেই বেশ অনেক্ষন সময় কেটে গেলো। এহতেশামের ওয়াশরুম থেকে ফেরার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। লোকটার পেট খারাপ নাকি? লোকটাকে আমার ভীষণ নার্ভাস প্রকৃতির মনে হয়েছে। নার্ভাস হলে অনেকের পেট খারাপ হয়। এই লোকের সাথে আমি দেখা করতে আসছি মনে করেই আমার ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেজাজ খারাপ করে অনেক্ষন বসে থাকার পরও এহতেশামের টিকিটাও দেখা যাচ্ছেনা। আশ্চর্য লোক তো। বাথরুম আসলেও আটকে রাখতে পারলোনা? কারো সাথে ডেটে এসে কেউ ওয়াশরুমে সময় কাটায়? আমার এবার একটু যেন ভয়ই লাগা শুরু করলো। নার্ভাস হয়ে হার্ট অ্যাটাক করে মরে গেলো না তো? আমার কী কিছু করা উচিত? এই ভাবতে ভাবতেই এহতেশাম সাহেবের আগমন। মুখ একই রকম হাসি হাসি। ঠিক সেই রকম বোকার মতো হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
– আপনাকে একা একা অনেক্ষন বসিয়ে রাখলাম।
আমার জানার ইচ্ছা ছিল যে সে সবসময় এতক্ষন ধরেই টয়লেট করে কিনা। তারপর মনে হলো, থাক কী দরকার। তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে বিদায় নিতে পারলেই আমি যেন বাঁচি।
ঠিক সেই মুহূর্তে ওয়েটারের আগমন। খাবার দেখে এহতেশাম উচ্ছসিত হয়ে বলে উঠলো,
– ওয়াট অ্য টাইমিং। ঠিক খাবার আসার আগেই চলে আসলাম।
আবারও সেই রকম বেকুবের মতো হাসি। বুঝাতে চাচ্ছে দেখো আমার কত বুদ্ধি। বুদ্ধির জোরে একেবারে সময়মতো হাজির হয়ে গেছি।
আমি কথা না বাড়িয়ে খাবারের দিকে মনোনিবেশ করলাম। খাবার ভীষণ মজার, বোধহয় অতিরিক্ত খিদা লাগার জন্য এত মজা লাগছে। এহতেশাম আবারও খেতে খেতে আমাকে দেখার চেষ্টা করছে। আমার একটু বিরক্ত লাগলেও মনেহলো “হু কেয়ারস”। আমি শান্তিমতো খেয়ে বাড়ি যাই।
খেতে খেতেই সে হঠাৎ বলে উঠলো,
– তো আপনার ডিসার্টেশন কেমন হলো?
আমি আমার প্লেটের দিকে তাকিয়েই বললাম,
– আজকে জমা দিয়ে দিলাম।
– লুকাসিয়ান প্রফেসর অফ ম্যাথমেটিক্স? ভেরি ইন্টারেষ্টিং টপিক।
আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। বললাম,
– হুম।
– কোন প্রফেসরকে আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে? আসলে সবাই যার যার অবদানের কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কাকে আপনার সবচেয়ে ভালো লেগেছে?
আমি এবার এহতেশামের দিকে সোজাসুজি তাকালাম। বললাম,
– আমি আসলে নিউটন, হকিংস আর চার্লস ব্যাবেজ এই তিনজন ছাড়া বাকিদের সম্পর্কে খুব একটা জানতাম না। ডিসার্টেশনের কারণে সবাইকে জানার সুযোগ হলো। একেকজনকে একেকরকমভাবে ভালো লেগেছে। একজনকে বেছে নেওয়া তো মুশকিল।
– তা তো বটেই। এই পোস্টটাকে তো পৃথিবীর সবচেয়ে “প্রেস্টিজিয়াস চেয়ার ইন সায়েন্স” ধরা হয়। আর সেই ১৬৬৩ সাল থেকে মাত্র ১৯জনের সৌভাগ্য হয়েছে এই প্রফেসসরশিপ পাওয়ার। এখানে সবাই অনন্য। কিন্তু তারপরও আমার হকিংসকেই সবচেয়ে ভালো লাগে। ওর সম্পর্কে চিন্তা করলে তো আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। এই দেখেন এখনো আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে।
এই বলে এহতেশাম আমার দিকে ওর হাতটা বাড়িয়ে গায়ের লোম খাড়া হওয়া দেখানোর চেষ্টা করছে। ওর কথা শুনে আমারও গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছা করছে ওর হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখতে।
বাকিটা সময় আমরা এই লুকাসিয়ান প্রফেসরদের গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। এহতেশাম দেখি সবার সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানে। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শুনছি। আমি আবার আমার ইমোশন লুকিয়ে রাখতে পারিনা। আমার বিরক্ত যেমন প্রকাশ হয়ে যায়, তেমনি আমার মুগ্ধতা প্রকাশ হয়ে যায়। আমার ধারণা এতক্ষন ওর প্রতি আমার তাচ্ছিল্যও যেমন ও বুঝতে পেরেছিলো, ঠিক তেমনি এই মুহূর্তে ওর প্রতি আমার মুগ্ধতাও ওর নজর এড়ায়নি। আমি খেয়াল করলাম ওর চেহারায় একটা শিশুর সরলতা আছে। এত জ্ঞানী ছেলেটা কিন্তু তাতেও সেই সরলতা ভাবটা যায়নি। সেই কারণেই ওকে মনেহয় বাচ্চা বাচ্চা লাগে। আর এই জন্যই ওকে মনেহয় আমার এত ভালো লাগছে।
আমরা কথা বলে যাচ্ছি… থিওরি অফ গ্রাভিটি, ব্ল্যাক হোল, মোটর নিউরোন ডিজিস, কসমোলজি, সফ্ট কন্টেন্ট ম্যাটার… এরকম আরো কত কী। মনেহচ্ছে এরমধ্যে অনেককিছু সম্পর্কেই আমাদের বিস্তারিত জ্ঞান নেই, শুধু ভাষাভাষা ধারণা। কিন্তু শব্দগুলো শুনতে পেরে বা আওড়াতে পেরেই আমি পুলকিত। এর মধ্যে আমরা ডেজার্ট অর্ডার করলাম, চা কফি খেলাম, এহতেশাম বিল মিটিয়ে দিলো। শেষ হয়ে গেলো আমাদের ডেটিং। পৃথিবীর সব ভালো জিনিসই যেন নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ হলোনা আমার মুগ্ধতা। আমি জানি এর রেশ ছড়িয়ে থাকবে বেশ কিছুদিন। এত ভালো সময় কাটবে যে আমি কল্পনায়ও ভাবতে পারিনি।।
এখন যাবার পালা। এহতেশাম আমার দিকে আবারো বোকা বোকা হাসি ছুড়ে দিয়ে বললো,
– আপনি তো টিউব ধরে বাড়ি ফিরবেন, আমি নিবো বাস। আর তো আপনার সাথে সময় কাটাতে পারছিনা। কিন্তু অনেক ভালো লাগলো আপনার সাথে গল্প করে।
আমার ওর এই হাসি আর মোটেও বোকা বোকা লাগছেনা। মনে হচ্ছে এটা হলো সরল হাসি – একেবারে পিওর হাসি। এই হাসিতে কোনো খাদ নেই। আমি বললাম,
– আমারও ভীষণ ভীষণ ভালো লেগেছে। থ্যাংক ইউ।
এবার এহতেশাম সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে বললো,
– আপনাকে আমার মনেহয় পছন্দ হয়েছে। যদিও পুরোপুরি এখনো শিওর না। আপনাকে একটু আঁতেল টাইপ মনে হয়েছে। কিন্তু আঁতেল যতটা না মনে হয়েছে তার চেয়েও অনেক বেশি বোকা মনে হয়েছে। লুকাসিয়ান প্রফেসরদের সম্পর্কে আমার কিছু জানা ছিলোনা। আমি ওয়াশরুমে গিয়ে মোবাইল ঘেটে কিছু তথ্য জেনে নিয়ে আপনার সাথে আড্ডা মেরেছি। আর আপনি এতেই দেখি একেবারে বিগলিত হয়ে গেলেন। এত বোকা হলে তো একটু মুশকিল।
আমার মনে হলো আমার মাথায় হঠাৎ করে বাজ পড়লো। আমার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হলোনা। আমাকে চুপ দেখে এহতেশামই আবার বলে উঠলো,
– তারপরও কেন জানি আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আমি নিজেকে খুব একটা জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান মনে করিনা। কিন্তু আপনাকে খুশি করার মতো বুদ্ধি আমার মনেহয় আছে। আর আপনাকে খুশি করার সুযোগ পেলে আমি কিন্তু খুশিই হবো। অবশ্য আপনি যদি সেই সুযোগ দিতে চান। তাড়াহুড়োর কিছু নাই। আপনি সময় নিয়ে চিন্তা করে দেখেন। আর আরেকদিন যদি আমার সাথে গল্প করে দেখতে চান, তাহলে জানাবেন। তবে কী নিয়ে গল্প করবেন সেই টপিকটা অবশ্যই আগে জানিয়ে দিবেন প্লিজ। আমি বাড়ি থেকে রিসার্চ করে আসবো। আপনাকে না দেখে ওয়াশরুমে বসে লুকাসিয়ান প্রফেসরদের তথ্য দেখা কিন্তু ভীষণ কষ্টকর।
এই বলে একটা মাদক হাসি ছুড়ে দিয়ে এহতেশাম বিদায় নিয়ে চলে গেলো। অপমানিত, লাঞ্চিত আমি চোখমুখ লাল করে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। এই লোকটা বোকা বোকা ভাব করে থাকলে কী হবে। এ তো দেখি মহা চালবাজ, ধুরন্ধর। এধরণের মানুষের সাথে আমি আর জীবনেও কথা বলতে চাইনা। কিন্তু তারপরও কেন যেন এর প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করছি, এক বাঁধভাঙা আকর্ষণ। এই ধরণের আকর্ষণের কোনো মানে আছে?
© আমিনা তাবাস্সুম