Ameena Tabassum

চোখের বাহিরে

ছোটবেলায় আমার মা-খালারা আদর করে বলতেন, আমার চোখ দুটি নাকি “ভাসা-ভাসা”। “ভাসা-ভাসা” চোখের মানেটা যে কী, তা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, কিন্তু তারা যে আমার চোখের প্রশংসা করতেন, সেটা ঠিকই বুঝতে পারতাম।

শ্যামবর্ণ আর অতিশয় সাদামাটা চেহারার কিশোরী আমি, প্রিয় মানুষদের কাছ থেকে নিজের চোখের এইটুকু প্রশংসা পেয়েই একেবারে বিগলিত হয়ে যেতাম। স্বপ্ন দেখতাম, কোনো প্রেমিক কিশোরও হয়তো কোনোদিন আমার এই “ভাসা-ভাসা” চোখের সমুদ্রে ভেসে যাবে।

এত দূরে ভেসে যাবে যে সেখান থেকে সাঁতরে ফিরে আসার কোনো উপায় থাকবে না। স্বপ্ন তো স্বপ্নই, তাই স্বপ্ন দেখাই সার। রক্ষণশীল পরিবারের কঠোর অনুশাসনের মধ্যে বেড়ে ওঠা, মেয়েদের স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করা আমার জীবনে কোনো ছেলের দেখা পাওয়াই ছিল বিরল ব্যাপার। আর সেই “ভাসা-ভাসা” চোখের ভাষায় কথা বলা তো দূরের কথা।

এরপরও আমাদের পাড়ার সুন্দরী মেয়েদের পেছনে অনেক যুবকরাই লেগে থাকত, কিন্তু আমি তো সেই সুন্দরীদের পর্যায়ে পড়িনি। তাই আমার প্রতি কেউ কখনো আকৃষ্ট হয়নি।
কলেজ শেষ হতে না হতেই দুবাইয়ে বসবাসরত এক খুবই সাধারণ ইঞ্জিনিয়ারের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব আসে। আমাদের এক প্রতিবেশীরই দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ছেলে সে। আমার মা তো সেই প্রস্তাবে একেবারে আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন যেন। তাদের কালো মেয়ের জন্য না চাইতেই এমন প্রস্তাব হেলায় ফেলে দেওয়া তো ঠিক না।

আমার বাবার ইচ্ছা ছিল মেয়েকে ভালোভাবে পড়াশোনা করানোর। তাই বাবা প্রথমে একটু দোনোমোনো করছিলেন। কিন্তু মা, খালা, ফুপুদের পীড়াপীড়িতে বাবাও শেষে রাজি হয়ে গেলেন।
পাত্র আমার থেকে দশ বছরের বড় আর একটু খাটো। সবাই বলাবলি করলেন যে, একটু বয়সে বড় পাত্রই নাকি ভালো। বউকে আদর-ভালোবাসাও দেবে আর শাসনও করবে। আর খাটো তো কোনো ব্যাপারই না। তাদের সাধারণ মেয়ের জন্য তো আর রাজপুত্র জুটবে না। আর তাছাড়া সেটেলড পুরুষ নাকি সোনার চামচ। সোনার চামচ বাঁকাই ভালো।

আর আমি? আমার মতামতের জন্য যদিও কেউ বসে ছিল না, কিন্তু আমি মনে মনে একটু খুশিই হয়েছিলাম। এতদিনে কেউ যদি আমার “ভাসা-ভাসা” চোখের ভাষা পড়তে পারে, এতেই আমি খুশি। বেশ ধুমধাম করেই আমার বিয়েটা হয়ে গেলো।
পাত্রপক্ষ বেশ দিলদরিয়া টাইপ। বিয়েতে তারা কোনো কার্পণ্য করেনি। আর আমি বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে, তারাও উজাড় করে বিয়েতে খরচ করেছেন।
বিয়ের সাত দিনের মাথায়ই আমার স্বামী দুবাইয়ে ফিরে গেলেন। আমি দেখলাম, বেশ নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার তাদের। শ্বশুরবাড়ির জীবন সম্পর্কিত যেসব কঠিন কঠিন অভিজ্ঞতার কথা ছোট থেকে শুনে এসেছি, তার ছিটেফোঁটাও আমাকে পোহাতে হয়নি।

বিয়ের পরের তিন মাস আমি নতুন বউ ভাব নিয়ে শ্বশুরবাড়ি আর বাবার বাড়ি মিলিয়ে কাটিয়ে দিলাম। তারপর কাগজপত্র সব ঠিক হয়ে গেলে তিন মাসের মাথায় আমিও দুবাই পাড়ি দিলাম।
আমার স্বামী তো কচি বউ পেয়ে একেবারে খুশিতে গদগদ। কিন্তু আমার চোখের প্রতি তার কোনোদিন দৃষ্টি গিয়েছে বলে মনে হয়নি। তার অবশ্য দোষ নেই কোনো। নতুন বউয়ের দেখার মতো অন্যান্য আকর্ষণীয় বস্তু নিয়েই সে ছিল দিশেহারা। চোখের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সুযোগ পেল কোথায় সে?

তারপর জীবন বয়ে চললো জীবনের নিয়মে। আর আমি বনে গেলাম একেবারে পাকা গিন্নি। তেইশ বছর বয়স না পেরোতেই আমার নিজের নতুন পরিচয় খুঁজে পেলাম। আমি হলাম তিন সন্তানের মা।
সংসারের কর্ত্রী আমি। সংসার চালাই বাকি চার সদস্যের প্রয়োজন অনুসারে একেবারে সুচারুভাবে। প্রত্যেকের পছন্দ অনুযায়ী পদের পদের রান্না করা আমার শখ। ঘরের আনাচে-কানাচে কোথাও এক বিন্দু ধুলা আমার পছন্দ নয়।
ঘরবাড়ি সবসময় ম্যাগাজিনের পাতার মতো সাজানো চাই। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা আর চালচলনের ব্যাপারে আমার সবসময় কড়া নজর। বাজার সদাই আমি নিজের হাতে করতে পছন্দ করি। সবার কাপড়-চোপড় বা অন্যকিছু আমি প্রয়োজনের আগেই ব্যবস্থা করে রাখতে চাই।

সপ্তাহান্তে মানুষ খাওয়াতে আমার ভালো লাগে। আমার এই গিন্নি জীবনের একটু হেরফের, একটু এদিক-ওদিক যাতে না হয়, সে ব্যাপারে আমি থাকি সদা তটস্থ।
এই গিন্নী জীবনের ভালোবাসা আর আনন্দের মধ্যে দিয়েই বিশ বছর পার করে দিলাম। এই বিশ বছরে ধীরে ধীরে প্রবাসের নির্ভেজাল তেল আর মাখনে এবং আমার পদের পদের রান্নার বদৌলতে আমার ছিপছিপে শরীরে মেদের আস্তরণের উপর আস্তরণ পড়ে গিয়েছে। সারাদিন রান্না আর ঘর পরিষ্কারের বাতিকে হাতের দিকে তাকালে মনে হয় যেন বাংলাদেশের কনস্ট্রাকশনের ইট ভাঙার মহিলার হাত।
মাথার চুল যেন একটু পাতলা হয়ে এসেছে, কিছুটা বয়সের কারণে আর বাকিটা অযত্নে অবহেলায়। মুখের সামান্য লাবণ্যটাও যেন আজ নিঃশেষিত। আর আমার ভাসা-ভাসা সেই দুটি চোখ? সেই চোখে আর কেউ ভাসা-ভাসি না করুক, চোখ দুটি নিজেই যেন দূরদূরান্তে ভেসে গিয়েছে। আয়নার দিকে তাকালে সেই চোখের ছিটেফোঁটাও আর দেখা যায় না।
সম্প্রতি ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাওয়ার কারণে ছুটোছুটির কাজ অনেকটা কমে এসেছে। চুপ করে বসে থাকার মানুষ আমি না। কোনো কাজ না থাকলেই ছেলেমেয়েদের উপর খবরদারি করতে লেগে যাই।
ছেলেমেয়েরা এখন বড়। বড় মেয়েটা তো ইউনিভার্সিটি শুরু করেছে। তাদের পিছে বেশি লেগে থাকলে তারা এখন বিরক্ত হয়। তাই তাদের উপর বেশি খবরদারিও করতে পারি না।
এই একটু বাড়তি সময় কাটানোর জন্য আজকাল ফেসবুকের নতুন নতুন গ্রুপের দিকে মন দিলাম। এক গ্রুপে রান্নাবান্নার ছবি দিই, আর অন্য এক গ্রুপে মুগ্ধ হয়ে সবার সৃজনশীল সৃষ্টিকর্ম দেখি। মুগ্ধ হয়ে গান শুনি, আবৃত্তি শুনি, লেখা পড়ি। ভালোই সময়ের শূন্যস্থানগুলো পূরণ হয়ে যায়।

সবচেয়ে ভালো লাগে আমার আবৃত্তি শুনতে। স্কুল-কলেজে থাকতে আমি নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি করতাম। আবৃত্তিকার হিসেবে আমার বেশ সুনাম ছিল। অন্যের আবৃত্তি শুনে নিজেকে আর সংযত রাখতে পারি না।
ইন্টারনেট ঘেঁটে সেই হারিয়ে যাওয়া কবিতাগুলো খুঁজে পেয়ে আপন মনেই আবৃত্তি করি। অবশ্য বেশিরভাগ সময় ইন্টারনেট ঘাঁটাও লাগে না। দেখলাম স্মৃতি অন্য সব ব্যাপারে বেইমানি করলেও কবিতাগুলো সযত্নে পুষে রেখেছে।
যুগ যুগ আগের কবিতাগুলো এখনও কেমন করে জানি দাঁড়ি-কমা সহ মুখস্থ আছে। আমি রান্না করি আর সাথে কবিতা আওড়াই। আবৃত্তি করতে করতে ঘর গুছাই। ঘুমের মধ্যেও যেন কবিতা স্বপ্ন দেখি। সবচেয়ে ভালো লাগে আমার চোখ নিয়ে লেখা সব কবিতাগুলো।

একদিন সাহস করে একটা আবৃত্তি মোবাইলে রেকর্ড করে সেই গ্রুপে পোস্ট করে দিলাম। ভিডিও-টিডিও আমার দ্বারা সম্ভব না। তারপরও নিজের একটা পুরোনো ক্লোজ শট ছবির চোখের উপর ফোকাস করে ভিডিও করে তার সাথে আবৃত্তি করে সাহস করে পোস্ট করলাম।

প্রথম পোস্টেই আশাতীত প্রতিক্রিয়া। আমি তো লজ্জায় কিছুদিন ফেসবুকই খুলে দেখিনি। কিন্তু এরপরই জড়তা কেটে গেলো। একের পর এক কবিতা আবৃত্তির ভিডিও পোস্ট করা শুরু করলাম।
বেশিরভাগ কবিতাই চোখ নিয়ে। চোখ নিয়ে যেন সব কবিতা আমাকে পড়ে ফেলতে হবে। প্রথম দিকে আবৃত্তির সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকতো আমার ফোকাস করা পুরোনো চোখের ছবি। এরপর ধীরে ধীরে সাহস করে চোখের ভিডিও করে কবিতার সাথে পোস্ট করা শুরু করলাম।
শুরু হলো আমার নতুন নেশা। কী ভয়ানক এই নেশা। দিন-রাত আমি যেন কবিতার মধ্যে ডুবে থাকি।
আমি পড়ি জীবনানন্দ দাশের “শঙ্খমালা”:
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি…..
আমি পড়ি রবীন্দ্রনাথের “কৃষ্ণকলি”:
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ…..
পড়ি নজরুলের “আমার কবিতা তুমি”:
প্রিয়া-রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতা তুমি,
আঁখির পলকে মরুভূমি যেন হয়ে গেল বনভূমি…
আজকাল আমার কবিতার প্রশংসা করে মানুষজন কমেন্ট করে, ইনবক্সে মেসেজ করে। সারাজীবন আমি যত না নিজের প্রশংসা শুনেছি, এই গত কয়েক মাসে যেন তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি প্রশংসা পেয়েছি।
প্রশংসা পেয়ে আমি খুশিতে আত্মহারা। আমি আমার নেশার ঘোরে আরো ডুবে যাই, ডুবে যাই আমার কবিতার ভুবনে।
ইনবক্সে মহিলা-পুরুষ সবাই মেসেজ করে। বেশিরভাগ পুরুষদের মেসেজই নিরীহ, শুধুমাত্র কবিতার প্রশংসা। কিন্তু এর মাঝেও কিছু ব্যতিক্রম আছে। মাঝে মাঝে কারও কারও কাছ থেকে ইনবক্সে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা বা গোলাপ পাই, কখনও কখনও পাই স্বরচিত প্রেমের কবিতা।
সম্প্রতি এক পুরুষ আমাকে প্রতিনিয়ত ইনবক্সে নক করছে। বেশিরভাগই আমার চোখের প্রশংসা করে টুকটাক মেসেজ।
যেমন প্রথম মেসেজ ছিল এইরকম,
-“আপনার আবৃত্তি শুনে আমি মুগ্ধ, আরও মুগ্ধ আপনার চোখদুটির দিকে তাকিয়ে। আমার মনে হলো:
‘প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস– তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।'”
এরপর দুইদিন পর আবারো মেসেজ:
-“কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুম চয়নে।
সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে।”
এরপর উত্তর না পেয়ে আবারো মেসেজ:
-“বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল, সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না?”
আমি মেসেজগুলো ঠিকই দেখি, কিন্তু দেখেই ডিলিট করে দেই। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না। তবে আমার কবিতার নেশা আর সোশ্যাল মিডিয়ার ভুবনের প্রতি আকর্ষণ আরও বেড়ে যায়।

সাথে সাথে যুক্ত হয় নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া। খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে রাতারাতি ওজন কমিয়ে ফেললাম। নতুন নতুন রূপচর্চা, ইয়োগা-মেডিটেশন, ওয়ার্ডরোবে পোশাকের বাহুল্য, আরও কত কী! এতে করে পরিবারের জন্য প্রতিদিন পদের পদের রান্নার আইটেম কমে এসে এক-দুই আইটেমে নেমে আসলো। ঘরের আনাচে-কানাচেতে একটু আধটু ধুলা জমতে থাকলো। স্বামীর চাহিদা মেটাতে গিয়ে ক্লান্ত লাগা শুরু করলো আর ছেলেমেয়েদের নজরদারিতে যেন অনেকটাই ছাড় দিয়ে দিলাম। মনে হলো, করলাম তো সবার জন্য কত কিছু। এখন না হয় নিজের জন্য একটু বাঁচি।

আমার পরিবার আমার নতুন এই পরিবর্তন যেন খুশি মনেই মেনে নিলো। ছেলেমেয়েরা মায়ের কড়া নজরদারি থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আর আমার স্বামী তো তার পুরানো বউয়ের নতুন রূপে আবার হয়ে গেল দিশেহারা।
আমার এই নতুন নেশার শুরুর দিকের ঘোর একটু কাটার পর দেখলাম সব খুবই ভালো লাগছে, আবার যেন ভালো লাগছেও না। আমি আমার পাকা গিন্নী জীবন মিস করি। আমার মধ্যে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমি আর আগের মতো সংসারে মন দিতে পারি না। আমি পড়ে থাকি আমার কবিতার নেশা নিয়ে। সবার প্রশংসা আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে।

আর সেই পুরুষ তো এখনও আমার চোখ নিয়ে কবিতা পাঠিয়েই যাচ্ছে। আমি সব মেসেজ ডিলিট করে দিই, কিন্তু এই পর্যন্তই। ডিলিট করে যেন আবার অপেক্ষায় থাকি তার পরবর্তী কবিতার। আমার মনে হয় এতদিন পর বুঝি কেউ আমার চোখের ভাষা বুঝতে পারলো।

আগামীকাল আমাদের বিবাহবার্ষিকী, একসাথে জীবন চলার বিশ বছর পূর্ণ হবে। প্রতি বিবাহবার্ষিকীতে আমি টেবিল ভরে আমার স্বামীর প্রিয় সব খাবার রান্না করি। দুই-তিন দিন আগে থেকে চলে এর প্রস্তুতি। আমার স্বামী আমার রান্না খেয়ে যতটুকু খুশি হয়, আমি রাঁধতে পেরে তার চেয়েও বেশি খুশি হই। আমার ছোট দুইটা আবার বাবার মতো খাদ্যরসিক। তারাও এই কারণে আমাদের বিবাহবার্ষিকী নিয়ে খুবই উত্তেজিত থাকে।

এইবার রান্না করতে হবে মনে করেই আমার ক্লান্ত লাগা শুরু করছে। একটুও ভালো লাগছে না। ভেবেছিলাম শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে অল্পের উপর দিয়ে কাজ চালিয়ে দেব। শরীর খারাপের অজুহাতে আগের রাতে না খেয়েই একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।

হঠাৎ রাত বারোটার সময় দেখি বাড়িতে একেবারে হৈচৈ কান্ড ঘটে যাচ্ছে। আমার ছোট ছেলে আমাকে রীতিমতো টানাটানি করে ঘুম থেকে তুলে দিল। ঘর থেকে বের হয়ে দেখি একেবারে এলাহী কান্ড। আমাদের বিশতম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে বাবা আর ছেলেমেয়েরা ঘরদোর সাজিয়ে বাইরে থেকে খাওয়া অর্ডার করে এনে একেবারে যা তা অবস্থা করে ফেলেছে।

আমাকে দেখা মাত্র বড় মেয়ে জানালো যে প্রতি বছর আমি এই দিনে অনেক কষ্ট করি দেখে তাদের বাবা এবার আমাকে কিছু করতে দেবে না বলে ঠিক করেছে। তাই এত আয়োজন। তাদের বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেও মিটিমিটি হাসছে। তার হাসি দেখে আমিও হাসলাম। আমরা সবাই হাসলাম, একসাথে গভীর রাত পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া করলাম আর সবার পক্ষ থেকে অনেক অনেক উপহার পেলাম।

সব উপহার আমার নতুন শখকে কেন্দ্র করে। আমার প্রিয় সব কবির কবিতার বইয়ের হার্ডকপি। কেমন করে এই বইগুলো জোগাড় হলো, তা আল্লাহই জানেন। নিশ্চয়ই দেশ থেকে আনানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, কবিতা রেকর্ড করার জন্য ভালো ক্যামেরা, মাইক্রোফোন আর সাথে নতুন ফোনও আছে।

আমাদের ফ্যামিলি রুমের একটা কর্নার যেখানে বাচ্চাদের বাবার জিনিসপত্রে ঠাসা ছিল, সেই জায়গাটা খালি করে আমার কবিতা পাঠের জায়গা বানিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।
এত আয়োজন দেখে আমার চোখে পানি চলে আসে, কিন্তু আমি কিছু বলি না। অনেক কষ্টে চোখের পানি চেপে রেখে হাসি হাসি মুখ করে বসে থাকি। আর আমার চারপাশের প্রিয় হাস্যোজ্জ্বল মুখগুলোকে প্রাণ ভরে দেখি। দেখি আমার সাজানো সংসার। নিজের হাতে সযত্নে গড়ে তোলা আমার বিশ বছরের সংসার। শ্রম, ভালোবাসা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা—সবকিছু উজাড় করে তিলতিল করে গড়ে তুলেছি আমার আজকের এই জীবন। আর এতদূর এসে কিসের মোহে এই সংসারের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছি?

বাকি রাতটা আমরা গল্পগুজব করে কাটিয়ে দিলাম। আমার নতুন ফোন, মাইক্রোফোন আর ক্যামেরার উদ্বোধন হলো। সবাই মিলে জোর করেই আমাকে দিয়ে একটা কবিতা পড়ালো। সেটা আবার রেকর্ড হলো। তা নিয়ে অনেক হাসাহাসিও হলো। আমি আমার নতুন অ্যাডমায়ারারদের ফেসবুক মেসেজের কথা সবাইকে শুনালাম। ছোট দুইটা তো হেসেই কুটিকুটি।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বড় মেয়ে কপট রাগ করে জানালো যে এখন তার নিজের অ্যাডমায়ারার জোগাড় করার কথা, আর তার মা কিনা মেয়েকে রেখে এসব করে বেড়াচ্ছে। আর তাদের বাবা তো সেই যে শুরু থেকে মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে তো হেসেই যাচ্ছে।

নাহ, এরপর আমি কবিতা আবৃত্তি ছেড়ে দিইনি। বরং আরও মনোযোগ দিয়ে আবৃত্তি করা শুরু করেছি। নতুন নতুন কবিতা শিখছি, কবিতা সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করছি, আবৃত্তির টেকনিক শিখছি। এইসব নিয়ে পড়াশোনা করছি। আর গ্রুপে পোস্ট করাও জারি রেখেছি।

কবিতা আমার জীবনে নতুন ছন্দ এনে দিয়েছে, যা এই বয়সে এসে খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সব করছি সংসারকে অবহেলা করে না, নেশার ঘোরে না, প্রশংসার মোহে না। আর সর্বোপরি অজানা পুরুষের কাছ থেকে আমার চোখের স্তুতিবাক্যের প্রতীক্ষায় না। যারা এই ধরনের অযাচিতভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে এখন, সবাই সাথে সাথে ব্লক হয়ে যায়।

আর আমার স্বামী মাঝে মাঝে কবিতা রেকর্ডের সময় অদূরে বসে তার নিজের কাজ করে। কখনও কখনও মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

নাহ, সে কবিতার খুব একটা ভক্ত না। আবৃত্তি নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। আমার ভাসা-ভাসা চোখ এখনো তার নজরে পড়েনি। তারপরও সে তার মতো করে স্ত্রীকে নিয়ে মুগ্ধ।

আমরা দুজন ভিন্ন মানুষ। আমি যেভাবে চেয়েছি, সে আমাকে সেভাবে কখনও দেখেনি। কিন্তু সে তার নিজের মতো করে দেখেছে, ভালোবেসেছে, সম্মান করেছে। এটাও তো একটা অর্জন।

এই অর্জনের পেছনে বিশ বছরের অনেক ত্যাগ, অনেক সমঝোতা, অনেক আপোষ, অনেক কষ্ট, অনেক আনন্দ, অনেক ভালোবাসা মিশে আছে। এই অর্জন আমার কাছে এখন হীরার মতো দামি। আর হীরা ফেলে যে কাঁচ তুলে নেয়, তার মনস্তাপের কোনো শেষ থাকে না।

© আমিনা তাবাস্সুম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top