Ameena Tabassum

মুক্তি

দীর্ঘ পঁচিশ বছর সংসার করার পর যখন মিনু আর মোর্শেদের ডিভোর্স হয়ে যায় তখন পরিচিতরা তো একেবারে তাজ্জব। আজকাল চারিদিকে ডিভোর্সের ছড়াছড়ি হলেও এই বিষয়ে এমনিতেই মানুষজনের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। তার উপর মিনুর বিবাহ বিচ্ছেদটা এতটাই অপ্রত্যাশিত যে এর মূল রহস্য বের করা না পর্যন্ত কারো যেন স্বস্তি হচ্ছেনা। যেমন খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করা না পর্যন্ত ডিটেক্টিভের কোনো শান্তি নেই, ঠিক তেমনিই এই অপ্রত্যাশিত বিচ্ছেদের রহস্য উদ্ঘাটন না করা পর্যন্ত পরিচিতদের সবার ঘুম হারাম।

মিনু আর মোর্শেদের পারিবারিকভাবে বিয়ে। পারিবারিকভাবে বিয়ে হলে কী হবে, শুরু থেকেই ওদেরকে দেখলে একেবারে সোনায় সোহাগা জুটি বলে হতো। মনে হতো প্রেম-ভালোবাসায় টইটুম্বর এক দম্পতি। শুধু মনে হতো বললে ঠিক হবেনা। আসলেই ওরা ছিল তাই। কখনো কোনো ব্যাপারে ওদের বিশাল মনোমালিন্য হয়নি, চোখে পড়ার মতো কোন ঝগড়া-ঝাটি হয়নি, সদা হাস্যোজ্জ্বল এক দম্পতি। এক পুত্র এবং এক কন্যার সুখী পরিবার। অবিবাহিতরা সবাই ওদের মতো দাম্পত্যজীবন চায় আর বিবাহিতরা ওদের দাম্পত্যজীবন নিয়ে ঈর্ষা করে। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের ওদের সংসারে কোনো খুঁত কারো কখনো চোখে পড়েনি। অনেকের মতেই সৃষ্টিকর্তা যেন পক্ষপাতিত্ব করে ওদেরকে একটু বেশিই দিয়েছিলেন। এই সব বেশি বেশি থাকতে থাকতেই যখন ওদের হুট করে বিচ্ছেদ হয়ে গেলো, তখন সবাই তো অবাক হবেই। কী হতে পারে এই বিচ্ছেদের কারণ? হয়তো বা কোন কারণ নেই। হয়তো বা বেশি ভালো ভালো না, তাই।

ডিভোর্সের সময় মিনুর বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর। সেসময় ওরা পাকাপোক্তভাবে ইংল্যান্ডে বসবাস করছে। বড় কন্যার বয়স তেইশ। ইংল্যান্ডের একটা স্কুলে ট্রেইনি টিচার হিসেবে চাকরি করছে। এক মিশরীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ছেলের সাথে প্রেমও করছে। খুব শীঘ্রই ওদের বিয়ের পরিকল্পনা। আর ছোটপুত্রের বয়স একুশ। কেবল গ্রাডুয়েশন শেষ করে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে। তার মানে সেসময় মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট জীবন মিনুর।

মিনু ওর বিবাহিত জীবনের সিংহভাগই হাউজওয়াইফ হিসেবে কাটিয়েছে। ওর সমস্ত সত্তা স্বামী, সংসার আর সন্তানদের জন্যই নিয়োজিত ছিলো। ছোট ছেলে ইউনিভার্সিটি শুরু করার পর জীবনে প্রথম ও চাকরি শুরু করে। আহামরি কোনো চাকরি না। ওদের বাসার কাছেই একটা ফার্মেসির ক্যাশিয়ার হিসেবে ফুল টাইম চাকরি। মিনুর চাকরির কোনো প্রয়োজন ছিলোনা। মোর্শেদের আয়-রোজগার বেশ ভালোই। কিন্তু বাচ্চারা বাসা ছেড়ে ইউনিভার্সিটির হলে উঠে যাবার পর রাতারাতি সংসারের কাজ কমে আসে। সেই শূন্যতা পূরণের জন্যই এই চাকরি। চাকরি শুরু করার পর মিনুর মনে হয়েছে ও যেন আরেক নতুন জীবন শুরু করেছে। নতুন রুটিন, নতুন ব্যস্ততা, নতুন মানুষজন, নতুন পরিবেশ আবার সামান্য হলেও নিজের নতুন আয়-রোজগার – সেটাও এক নতুন অনুভূতি। অনেকেই ভেবেছিলো ছেলেমেয়েরা যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায়, সন্তান অন্তপ্রাণ মিনু একেবারে ভেঙে পড়বে। এটা ঠিক যে বাচ্চাদের জন্য মিনুর মন কেমন করতো। ওরা কী করছে, কী করছেনা এসব নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তাই হতো। কিন্তু তারপরও জীবনের এই নতুনত্ব মিনুর ভালোই লাগছিলো। মনেহয়েছিলো জীবনের এক অধ্যায় শেষে নতুন আরেক অধ্যায়ের শুরু। মন্দ কী?

জীবনের এই নতুন অধ্যায়ে ওদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে যে হঠাৎ কেমন করে ফাটল ধরলো বা ছেদ পড়লো সেটা এখনো মিনু ঠিক হিসাব নিকাশ করে বের করতে পারেনি। তবে যতই চিন্তা করে মিনু, ততই ওর মনেহয় হঠাৎ করে ফাটল ধরেনি। শুরু থেকেই একটা বিশাল ফাটল ছিলো। আর সেই ফাটল অতিরিক্ত সব দিয়ে বাইরে থেকে ঢেকে রাখা হয়েছিলো, অন্তত মিনুর পক্ষ থেকে। অতিরিক্ত যত্ন, অতিরিক্ত ভালোবাসা, অতিরিক্ত সব কিছু। আর বাইরে অতিরিক্ত সব দিতে দিতে ধীরে ধীরে ভিতরে ভিতরে মিনু একেবারে নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিলো। তা না হলে পঁচিশ বছরের ফুলের মতো সাজানো সংসারটা ভেঙে দেওয়া এত সহজ হলো কেমন করে?

প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেলো ওদের ডিভোর্সের। এই পাঁচ বছরে মিনু অনেক চিন্তা করে বুঝতে চেয়েছে যে ভুল হয়ে গেলো নাকি? স্বামী-স্ত্রীর ফারাক তো থাকবেই, ফাটল তো থাকবেই, জীবনে অপূর্ণতা তো থাকবেই, সংসারে অপ্রাপ্তি তো থাকবেই। তাই বলে পঁচিশ বছরের তিল তিল করে গড়ে তোলা যত্নের সংসার কি কেউ বোকার মতো এভাবে ভেঙে দেয়? হয়তো বা দেয় না। সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুসারে দেয়াও ঠিক না। কিন্তু মিনু দিয়েছে। আর কেন দিয়েছে এর সঠিক উত্তর মিনুর জানা নেই। তবে মিনু উত্তর খুঁজে না পেলেও, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত-অপরিচিতরা এখনো বহাল তবিয়তে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে যাচ্ছে।

গোসল করতে করতে মিনু ওর জীবনের এই নানান ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলো। আজ মিনু ঠিক করেছিলো যে গোসল শেষ করেই ও গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে বের হয়ে যাবে। আজ কিছুতেই শাওয়ারের স্ক্রিন পরিষ্কার করবে না। কিন্তু এই বিবাহ-বিচ্ছেদ ভাবনা ভাবতে ভাবতে কখন যে গোসল শেষে স্কুইজিটা নিয়ে টেনে টেনে সমস্ত টাইল ঝকঝকে করে পরিষ্কার করে ফেললো যে খেয়ালই করেনি মিনু। শুধু তাই না, মোছার কাপড়টা নিয়ে শাওয়ার হ্যান্ডেলটা মুছে দিলো। ব্যবহার করা শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, বডি ওয়াশ সব শুকনো করে মুছে আবার জায়গা মতো সাজিয়ে রাখলো। শাওয়ারে গরম পানি ছেড়ে গোসল করার কারণে, বেসিনের উপরের আয়নাটা ঘোলা হয়ে গেছে। সেটাও যত্ন করে মুছে দিলো। বেসিনটাও ভিজে আছে। সেটাও পাশে রাখা স্পঞ্জ দিয়ে সুন্দর করে মুছে রাখলো। মিনু বেশ ঝটপট কাজ করে সবসময়। গোসল শেষ করতে ওর সর্বসাকুল্যে লেগেছে দশ মিনিট আর এরপর বাথরুম ঝকঝকে তকতকে করতে গেলে গেলো আরো দশ মিনিট। গোসল শেষে বেরিয়ে এসেই মিনু জিভ কাটলো। আজ না ঠিক করেছিলো যে কিছুতেই গোসলের পর বাথরুম পরিষ্কার করবে না? আর ও একা মানুষ, ছোট্ট একরুমের একটা ফ্ল্যাটে থাকে। বাড়ি, ঘর, বাথরুম তো পরিষ্কারই থাকে, ময়লা হয়না। বাথরুম ও সাথে সাথে না মুছে রাখলেও একটু পর সব শুকিয়ে এমনিতেই ঝকঝকে হয়ে যেত। কিন্তু অনেক চেষ্টা করার পরও এত বছরের এই খুঁটিনাটি অভ্যাসগুলো মিনু ছাড়তে পারছেনা। ওর জীবনে আর মোর্শেদ নেই। কিন্তু মোর্শেদের পছন্দ অনুসারে জীবন পরিচালনা করা বন্ধ করতে পারেনি মিনু।

বিয়ের পর থেকেই মোর্শেদের পছন্দমতো এই অভ্যাসগুলো মিনু রপ্ত করেছে। বাসার প্রত্যেকটা জিনিস একেবারে গুছানো, টিপটপ পরিষ্কার রাখা চাই। শুধু বাসার জিনিসই না মিনুর নিজেকেও গোছানো পরিপাটি হয়ে থাকতে হবে। বাচ্চাদের সবকিছু একেবারে নিয়ম মেনে চলতে হবে। এভাবে চলা যাবেনা, ওভাবে চলা যাবেনা। এটা করা যাবেনা, ওটা করা যাবেনা। এর সাথে মেশা যাবেনা তো ওর সাথে মেশা যাবেনা, নানান বিধিনিষেধ। আবার এটা করতেই হবে, ওটা করতেই হবে, এটা শুধুমাত্র এভাবেই করতে হবে, ওটা শুধুমাত্র ওভাবেই করতে হবে। মোর্শেদ খারাপ কখনো কিছু বলেনি। শুধু ওর মতো করে, ওর নির্দেশ অনুসারে, ওর পছন্দ-অনুসারে সব করতে হবে। এই আর কী। মিনুর এসবে কোনো আপত্তি ছিলোনা, না ছিল তেমন কোনো অভিযোগ। মোর্শেদের সিদ্ধান্তে মিনুর ছিল পূর্ণ আস্থা। মিনুর বিশ্বাস ছিল যে ওর মতো সবকিছু করার কারণেই ওদের সংসারের সবকিছু একেবারে নিখুঁতভাবে চলতো। মিনু যন্ত্রমানবীর মতো মোর্শেদের পছন্দ অনুসারে সবকিছু পালন করতো। মোর্শেদও একারণে মিনুকে ভালোবাসতো, সম্মান করতো। আর সবার চোখে ওরা ছিলো সোনায় সোহাগা জুটি।

তারপর এতবছর পর হুট্ করে যে মিনুর কী হলো। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে মিনু এত বাড়াবাড়ি করে ফেললো।

সেইদিন সারাদিন ফার্মেসির কাজ শেষে মিনু ঘরে ফিরে ঘরের কাজগুলো সারছিলো। ফার্মেসির কাজও তেমন কষ্টের না। বাচ্চারা ইউনিভার্সিটিতে চলে যাবার পর তো ঘরের কাজও একেবারে কমে এসেছিলো। ঘরের টুকটাক কাজ সেরে রাইস কুকারে ওর আর মোর্শেদের জন্য ভাত চড়িয়ে তিন ধরণের ভর্তা করে ফেলেছিলো মিনু। ভেবেছিলো মোর্শেদ এলে দুজনের জন্য দুটো ডিম ভেজে ফেলবে। মোর্শেদ একটু দেরি করেই বাড়ি ফেরে।মিনু ঠিক করেছিলো এর মধ্যে গোসল সেরে, মেয়ের সাথে ভিডিও কল করে কিছুক্ষন কথা বলে নিবে। ওদের মেয়ে লাবণ্য কী যেন দুশ্চিন্তায় ভুগছে। আজকাল কেমন মনমরা হয়ে থাকে। বেশ কিছুদিন মিনু নানান কথা জিজ্ঞেস করে করেও কিছু বের করতে পারেনি। আজ লাবণ্য নিজে থেকেই কথা বলতে চেয়েছে। আর নিজেই সময় দিয়েছে রাত আটটার সময় ভিডিও কল করবে। এই নিয়ে মিনু একটু অশান্তির মধ্যে ছিল। আল্লাহ আল্লাহ করে সিরিয়াস কোনো সমস্যা যাতে না হয়। কিন্তু ঠিক গোসল করতে যাবার সময়ই মোর্শেদের ফোন। ফোন ধরতেই বলে উঠলো, ঝটপট রেডি হয়ে নাও। দশ মিনিটের মধ্যেই তোমাকে বাসা থেকে তুলে নিচ্ছি। হাসান আর ভাবীর সাথে “শের এ খান” রেস্টুরেন্টে ডিনার করবো।

হাসান আর ভাবীকে নাকি মোর্শেদ “শের এ খান” রেস্টুরেন্টের নেহারির দাওয়াত করেছে। ওনারা কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে যাবে।

মোর্শেদের এরকম হুটহাট পরিকল্পনার সাথে মিনু চিরপরিচিত। বছরের বেশিরভাগ দিনই মোর্শেদের এটা সেটা পরিকল্পনা চলতে থাকে। বাসা ভর্তি দাওয়াত চলছে, তো দল ধরে পিকনিক হচ্ছে, তো রাত বিরেতে লং ড্রাইভে যাওয়া হচ্ছে, তো এই চলছে তো সেই চলছে। চলছে তো চলছেই। মিনুও সবকিছুতে খুশি মনেই যুক্ত হয়। কিন্তু সেইদিন হঠাৎ বলে উঠলো,

– আমি তো এখন কোথাও যেতে পারবোনা। লাবণ্যের সাথে কথা বলতে হবে।

মোর্শেদ তো মিনুর এধরণের জবাবে অবাক। ও বলে উঠলো,

– লাবণ্যের সাথে কথা বলতে হবে তো কথা বলবে। গাড়িতে বসেই কথা বলতে পারবে। এর সাথে না যাওয়ার সম্পর্ক কী?

– নাহ, ও কী জানি বলতে চায়। ওর সাথে একটু শান্তিমতো কথা বলতে চাই। হুড়োহুড়ি করতে ইচ্ছা করছে না।

– হুড়োহুড়ির কী আছে? গাড়িতে আরাম করে বসেই কথা বলো। আর কী এত দরকারি কথা?

– কী কথা জানিনা। দেখছোই তো, মেয়েটা কেমন মনমরা থাকছে কিছুদিন। আজকে ওর সাথে কথা বলি। আজকে আমি যাবোনা।

– যাবেনা বললেই হলো। হাসান আর ভাবি তো আমি বলে ফেলেছি। আমি দাওয়াত দিলাম। আমরা ফ্রি দেখেই দাওয়াত দিলাম। এখন মেয়ের সাথে কথা বলতে হবে বলে কী আলগা ঢং শুরু করলে?

– আমরা ফ্রি দেখে দাওয়াত করোনি। তুমি ফ্রি দেখে দাওয়াত করেছো। আমাকে জিজ্ঞেস করেছো যে আমি ফ্রি কি ফ্রি না? জিজ্ঞেস করোনি। কোনোদিনই অবশ্য করোনা। সেটা ব্যাপার না। কিন্তু আজকে আমি ফ্রি না। আমি যেতে পারবোনা। তোমার দাওয়াত, তুমি গিয়ে ওনাদের আপ্যায়ন করো।

মিনু আজও জানেনা যে সেদিন ওর কী হয়েছিলো। এই কথাগুলো স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার সাধারণ কিছু কথাবার্তা মনে হতে পারে। কিন্তু ওদের পরিবারে এটা সাধারণ কোনো কথা ছিলোনা। মিনু কখনো এভাবে কিছু বলেনা এবং বলেনি। মোর্শেদ সব ভালো জানে, ভালো বুঝে আর সেভাবেই সব পরিকল্পনা হয় আর সেভাবেই মিনু সব করে এসেছে। আজ হঠাৎ মিনুর এধরণের প্রতিক্রিয়ায় মোর্শেদের মাথায় যেন হুট করে রক্ত উঠে গেলো। ও খেপে গিয়ে বলে উঠলো,

– ফালতু কথা বলার জায়গা পাওনা। তোমার দাওয়াত মানে? আমার তোমার দাওয়াতের মধ্যে আবার কবে থেকে পার্থক্য শুরু হলো? সত্যি করে বলো কী হয়েছে?

– সত্যি কথা বললামই তো। আমি রান্না করে ফেলেছি। আমি তোমার দশ মিনিটে রেডি হতে পারবো না আর চাইও না। আমি গোসল সেরে, লাবণ্যের সাথে কথা বলে, ভর্তা আর ডিমভাজি দিয়ে গরম ভাত খাবো। আমি কোথাও যাচ্ছিনা।

এরপর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মোর্শেদ বাসায় ফিরে আসে। এরপর শুরু হয় তুলকালাম কান্ড। প্রথমেই লাবন্যকে ফোন করে মোর্শেদ ভীষণভাবে ঝাড়ি দেওয়া শুরু করে। মোর্শেদের সবসময়ই একটু রাগ বেশি। মিনুর সাথে খুব একটা রাগারাগি হয়না কারণ মোর্শেদের সবকিছু মিনু মেনে চলে। অবশ্য না মেনে চলার মতো কিছু মোর্শেদ তেমন বলেও না। কিন্তু সেইদিন মিনুর এই আচানক ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া প্রথমে মেয়ের উপর ঝাড়া হলো। কী কথা বলতে চায় সে? কী নিয়ে মন খারাপ তার? মিনুকে কেন সে বাইরে যেতে মানা করেছে? এত বড় ধামড়ি মেয়ে হয়ে গেছে কিন্তু এখনো মা ছাড়া চলতে পারেনা?

লাবণ্য তো কিছুই জানেনা। সে বাবার এই রকম অকারণ রাগারাগি দেখে একেবারেই তাজ্জব। যদিও লাবণ্য ওর বাবার রাগ সম্পর্কে অবগত। ওরা দুইভাইবোন ওদের বাবাকে এই রাগের কারণে অনেক ভয় পায়। কিন্তু সেদিন তো লাবণ্যের কোনো হাতই নেই। ও তো কিছুই জানে না। তাই বাবার আকস্মিক এই রাগে লাবণ্য তো কান্নাকাটি করে অস্থির করে ফেললো। লাবণ্যের কান্না দেখে মোর্শেদের মেয়ের উপর রাগ পড়ে গিয়ে মিনুর উপর রাগ যেন আরো বেড়ে গেলো। মিনুকে বলে উঠলো,

– শুধু শুধু তুমি চালাকি করে মেয়ের নামে কথা বলে ওকে এত বকা খাওয়ালে। লাবণ্য তো কিছুই জানে না, কিছুই বলে নি। তোমারই সব সমস্যা। কী হয়েছে তোমার? হঠাৎ এরকম ন্যাকামি শুরু করলে কেন? যাও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। এই নিয়ে আর একটাও কথা শুনতে চাই না।

– না রেডি হবো না। তোমার দাওয়াতে যাবোনা। তোমার সাথে কোথাও যাবো না। এমন কি তোমার সাথে সংসারও করবো না। অনেক হয়েছে এই সংসার। যেই সংসারে নিজের ইচ্ছাটুকু প্রকাশ করলে, কিছু নিয়ে প্রতিবাদ করলে, এরকম প্রতিক্রিয়া হয়, সেই সংসার আমি করতে চাইনা।

এরপর কিভাবে কী হলো মিনু নিজেও জানে না। মোর্শেদ প্রথমে অনেক অনেক অনেক রেগে গিয়েছিলো। একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে মিনুর এতো চরম প্রতিক্রিয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। কিন্তু তারপর দু’তিন দিন পর একেবারেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলো কোনো একটা কারণে মিনুর ভীষণ রাগ বা মন খারাপ হয়েছে। তাই এরকম ব্যবহার করছে আর এরকম যুক্তিহীন কথা বলেছে। মিনুর কাছে ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেসও করেছিলো যে কী হয়েছিলো সেইদিন, কেন এরকম করলো ও?

মিনু কোনো জবাব দিতে পারেনি। ও নিজেই জানেনা কেন এরকম স্বভাববিরুদ্ধ আচরণ করেছিলো মিনু। মোর্শেদ এরকম ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় মিনুর খুশি হওয়া উচিত ছিল। রাগের মাথায় কী অলুক্ষুণে কথাই না বলে ফেলেছিলো। কিন্তু কোনো একটা কারণে মিনুর মনে হতে লাগলো অলুক্ষুণে কোনো কথা না, রাগের মাথায় কোনো কথা না, হুট্ করে কোনো কথা না। এটাই মিনুর মনের কথা। মনের অন্ধকার এক কোটরের ছাইচাপা আগুনের মতো। হঠাৎ করেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিলো। যেই আগুন নেভানোর ক্ষমতা মিনুর নেই।

এরপর মাসের পর মাস ধরে চলতে লাগলো মোর্শেদের রাগ, ঝগড়া, মাফ চাওয়া, সমঝোতার চেষ্টা, ভালোবাসার প্রকাশ, হতাশা আবার রাগ, ঝগড়া, মাফ চাওয়া … কোনোকিছুই যেন মিনুকে আর স্পর্শ করতে পারেনি। ওর একই কথা। মিনু এই সংসার করতে চায়না। এই সংসারে এত বছর ধরে সবকিছু একজনের পুঙ্খানুপুঙ্খ চাহিদা মোতাবেক সব মিনু সুচারুভাবে করে এসেছে। এই কাপড় পরো তো সেই কাপড় পরোনা, এখানে টাকা খরচ করো তো ওখানে টাকা খরচ করোনা, এভাবে রান্না করো তো ওভাবে রান্না করোনা, এদের দাওয়াত করো তো ওদের দাওয়াত কোরো না, এখন বেড়াতে চলো তো তখন বেড়ানো যাবেনা। ছেলেমেয়েদেরকে দিয়ে কী কী করাতে হবে, আত্মীয়স্বজনদের সাথে কিভাবে চলতে হবে, আলমারি কিভাবে গুছিয়ে রাখতে হবে, বাজার কী করতে হবে থেকে শুরু করে বিছানায় কখন কিভাবে মিলিত হতে হবে সব মোর্শেদের ঠিক করে দেওয়া নিয়ম অনুসারে করতে হবে। খারাপ কোনো কিছু মোর্শেদ কোনোদিন বলেনি। সবকিছুই সংসারের ভালোর জন্য বলেছে, মিনুর ভালো জন্যই বলেছে, সবার ভালো ভেবেই বলেছে। কিন্তু ওর বেঁধে দেওয়া ভালো নিয়মই একমাত্র ভালো। তাই এর একটু এদিক ওদিক করা যাবেনা। একটু এদিক ওদিক করতে চাইলেই অশান্তি শুরু হয়ে যেত। আর অশান্তি এড়াতে মোর্শেদের ভালোটাই মিনু ভালো চোখে দেখেছে। এতে যে খারাপ কিছু হয়েছে তা না। কিন্তু মিনু নিজেই বুঝেনি যে ওর হাঁফ ধরে গেছে। ও আর পারছেনা।

মোর্শেদ মিনুকে কম মানানোর চেষ্টা করেনি। ওরই বা কী দোষ। মিনুর মনের মধ্যে যে এত চাপা ক্ষোভ সেটা না বুঝালে মোর্শেদই বা বুঝবে কীভাবে। তাছাড়া বিয়ের পর থেকেই মোর্শেদ ভেবেছে মিনু একটু বোকা প্রকৃতির মেয়ে। এমনি কাজে কর্মে বুদ্ধিমতী কিন্তু আচরণে বোকা। মোর্শেদ ওকে ঠিকঠাকমতো নিয়ন্ত্রণ না করলে এই সংসারের কিছুই ঠিকঠাকমতো হতো নাকি তা নিয়ে মোর্শেদের সন্দেহ আছে। তাই মিনুর ছোটোখাটো তাল বাহানা, ইচ্ছা অনিচ্ছা মোর্শেদকে পাত্তা না দিয়ে চলতে হয়েছে। তাই বলে মিনুকে তো কম ভালোবাসেনি। আজ হঠাৎ করে মিনুর এত ক্ষোভ কোথা থেকে আসলো যে সংসারই সে করবেনা। এ যে ভীষণ রকমের বাড়াবাড়ি। ভীষণ রকমের অন্যায়।

এরপর মোর্শেদ ছেলেমেয়েদেরকে দিয়ে মিনুকে বুঝানোর চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু ছেলে মেয়েরা কেন জানি মিনুকে কিছু জোর করেনি। বিদেশে বড় হওয়া ছেলে মেয়ে দেখে কি? নাকি ওরা ওদের মায়ের হাঁফ ধরা জীবনের সাক্ষী বলে? মিনু জানে না। তবে ওরা বলেছিলো যে মা তোমার যেটাতে শান্তি সেটাই করো। আমরা তোমার সাথে আছি। আর আমরা বাবারও সাথে আছি। কেবল মাত্র ওরা দুইজনই মিনুকে টলাতে পারতো, থামাতে পারতো। ওদের সামান্য বাধা মিনুকে ভেঙে দিতে পারতো। কিন্তু ওদের এই কথায় মিনুর সাহস আর শক্তি দুটোই যেন আরো বেড়ে যায়।

ছেলেমেয়েদের দিয়ে কিছু কাজ না হবার পরও মোর্শেদ ভেবেছিলো যে সময়ের সাথে সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। মিনুর জেদ, রাগ কমে আসবে। মিনু ওর ভুল বুঝতে পারবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন দেখলো যে কিছুই হলোনা তখন মোর্শেদের ভারী রাগ আর অভিমান হলো। ওর একবার মনেহলো কেমন স্বার্থপর মিনু। দুইদিন চাকরি করে নিজের মতো নিজের জীবন সাজাতে চাইছে। আরেকবার মনেহলো নিশ্চয়ই মিনু কারো সাথে পরকীয়া করছে। তা না হলে ওর মতো সংসারী মেয়ে কিভাবে এমন চাইতে পারে। আবার মনেহলো, সারাজীবন ও বোকা বোকা ভাব করে ছিলো। শাবানা সেজে সংসার করে ছেলে মেয়েদের বড় করেই এখন নিজের রাস্তা দেখছে। তারপর আবার মোর্শেদের রাগ কমে এলো। কেন যেন নিজেই নরম হয়ে গেলো। জীবনে এই প্রথম। যদিও মোর্শেদ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে ও কিছুই করেনি তারপরও মিনুকে বললো ঠিক আছে তোমার সংসার তুমি তোমার মতো করে করবে। আমি আজ থেকে আর কিছুই বলবোনা। তুমি যা বলবে সেভাবেই সব হবে। ঠিক আছে? কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেওনা। তোমাকে যে অনেক ভালোবাসি।

মোর্শেদের এই কথা মিনুকে টলাতে পারেনি। মিনু মোর্শেদকে খুব ভালোভাবে চিনে। কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ খাটানো ওর চরিত্রের অংশ। ওর অস্থি মজ্জায় মিশে আছে। কর্তৃত্ব না খাটিয়ে ও থাকতে পারবে না। আর যদি পারেও তাহলে ওর জীবনের আনন্দ, স্বাধীনতা, স্বস্তি থাকবেনা। মোর্শেদের তখন এই সংসারে হাঁফ ধরে যাবে। মিনু তো তা চায় না।

তাছাড়া, ভালোবাসা বড়ই দুর্বোধ্য ব্যাপার। মিনু কি মোর্শেদকে ভালোবাসে না? অবশ্যই বাসে। তা না হলে এতবছর সংসার করলো কেমন করে? ভালোবাসার অনেক দিক, অনেক বৈশিষ্ট্য – এতে মায়া আছে, ভালোলাগা আছে, সমঝোতা আছে, ছাড় দেওয়া আছে, নির্ভরতা আছে। আর এতে আছে স্বস্তি এবং স্বাধীনতা। মোর্শেদের প্রতি মিনুর মায়া ঠিকই আছে। মিনুর মতো মোর্শেদের হিতাকাঙ্খী আর কে আছে? কিন্তু যেই ভালোবাসায় সামান্য স্বস্তি আর স্বাধীনতা নেই, সেই ভালোবাসা সোনা দিয়ে মোড়ানো হলেও একসময় বন্ধ সিন্দুকের মতো মনেহয়। চোখ ধাঁধানো কিন্তু দম বন্ধ করা। তাই মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নেবার জন্য একসময় জানটা ছটফট করতে থাকে। সেই সামান্য মুক্ত বাতাসের জন্য সারাজীবনের সঞ্চয় দামি স্বর্ণস্তুপ ফেলে আসতে এক মুহূর্ত দ্বিধাবোধ হয়না।
মুক্ত জীবনের পাঁচ বছরে মিনু মোর্শেদের পছন্দের বেশিরভাগ অভ্যাসই ছেড়ে দিতে পারেনি। মুক্ত জীবনের পাঁচ বছর শান্তি, আনন্দ, স্বাচ্ছন্দ্যে পরিপূর্ণ ঝলমলে পাঁচ বছর মোটেও না। মুক্ত জীবনের পাঁচ বছরের প্রায় মুহূর্তেই মিনু মোর্শেদকে কষ্ট দিয়েছে বলে নিজে কষ্ট পেয়ে বসে থাকে। কিন্তু তারপরও মিনুর মনেহয় মিনু যেন প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারে আজকাল।

মুক্ত বাতাসের জন্য ছটফট করলেও, মুক্ত হবার সুযোগ বা সাহস কজনের হয়? মিনুর মনেহয় মিনু অনেক ভাগ্যবতী।

© আমিনা তাবাস্সুম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top